শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দেশীয় পর্যটন বিকাশের সুযোগ

মো. কামরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

কোভিড-১৯ মহামারি সারাবিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে অনেক কিছুই। প্রত্যেকের দুর্বলতাগুলোকেও দেখিয়ে দিয়েছে চোখে আঙ্গুল দিয়ে। পরনির্ভরশীলতাকে দূরে ঠেলে আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯। বিশ্ব বাণিজ্যের দু’একটি খাত ছাড়া সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো বার্ষিক পরিকল্পনাই কাজে আসেনি। স্বল্পমেয়াদী দীর্ঘমেয়াদী কিংবা অতিদীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনাই কোভিডের কাছে টিকতে পারেনি। উন্নত বিশ্ব কিংবা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ অথবা আফ্রিকার অনুন্নত দেশসমূহ কেউ কোভিড-১৯ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। পরম পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাধর ভারত কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশ করোনাভাইরাসের কাছে পর্যদুস্ত হয়েছে, হচ্ছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসা। আর কোভিড-১৯ দেখিয়েছে সারাবিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থাই অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত অন্যতম একটি খাত হচ্ছে পর্যটন।

কোভিড-১৯ এর কারণে বিমান চলাচল ও পর্যটন খাত চরমভাবে বিপর্যস্ত। যেসব দেশের আয়ের প্রধান খাতই পর্যটন, সেখানে অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় হওয়ার শংকায়ও পড়েছে। সারাবিশ্বের আকাশপথ অনেকটা লকডাউন ছিলো। ধীরে ধীরে সেই আকাশ খুলতে শুরু করেছে। বিভিন্ন শর্তারোপের মাঝেই এয়ারলাইন্সগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি মাথায় নিয়ে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে ব্যবসার ভিন্নতার মাঝেই আয়ের উৎস খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছে। সারাবিশ্বে পর্যটনখাত একটি অন্যতম শক্তিশালী শিল্পখাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। বাংলাদেশে ইনবাউন্ড আউটবাউন্ড ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে শতশত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো, যেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিলো। করোনা ভাইরাসের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গত এক দশকে বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বাংলাদেশে আভ্যন্তরীণ পর্যটক শ্রেণি গড়ে উঠে। যারা সুযোগ পেলেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের বিভিন্ন আকর্ষণীয় গন্তব্যে ভ্রমণ করার অভ্যাস গড়ে তুলে। ভ্রমণ করার পরিকল্পনার সাথে আয়ের সক্ষমতাও একটা বড় ব্যাপার।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ার কারণে, সহজলভ্য ট্যুরিস্ট ভিসা প্রাপ্তিও একটা বড় বিষয়। একটা সময় বাংলাদেশে পর্যটন বলতেই আমরা বুঝতাম কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত অথবা সিলেটের চা-বাগান কিংবা সুন্দরবন। সেটাও আবার শীতকাল কেন্দ্রিক। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও শুধুমাত্র শীতকালে সপ্তাহে দু’টি কিংবা তিনটি ফ্লাইট পরিচালিত হতো ঢাকা থেকে কক্সবাজার। হাতে গোনা কিছু ভালো মানের হোটেল (বেশিরভাগই পর্যটন কর্পোরেশন পরিচালিত) ছিলো। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের যাত্রা শুরুর পর থেকেই কক্সবাজারে সারা বছর ফ্লাইট পরিচালনা করতে থাকে। সেই সংগে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠতে থাকে আন্তর্জাতিক মানের চার/পাঁচ তারকা হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। ফলে দেশীয় পর্যটকদের পাল্লা দিয়ে বিদেশি পর্যটক বাড়তে থাকে। ফলে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

গত সাত বছরে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটনকে উৎসাহিত করেছে। সারাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক উন্নতমানের হোটেল, মোটেল কিংবা রিসোর্ট। মানুষ একটু সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেড়িয়ে পরে পরিবার পরিজন নিয়ে। আজ কোভিড-১৯ এর কারণে এভিয়েশন, ট্যুরিজম এর সাথে হোটেল ব্যবসায়ও চরম ধ্বস নেমেছে। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী কিংবা কর্মী সকলেই একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কোভিড-১৯ এর বিস্তার জ্যামিতিক হারে না বাড়লেও গাণিতিক হারে এখনো বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সরকার বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিয়ে এভিয়েশন, ট্যুরিজম ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিজকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কিংবা এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের ভবিষ্যতকে নিরাপদ রাখতে ১ জুন থেকে ধারাবহিকভাবে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। প্রথম দিকের তুলনায় বর্তমানে কিছুটা যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বহির্বিশ্ব থেকে যাত্রী আসা বন্ধ বলা চলে, পর্যটক শূন্যতা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে ওয়ার্ক স্টেশন ছেড়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও মুভমেন্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। সবাই ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নানাবিধ কারণে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি কিছু বিধি নিষেধ। এত কিছুর পরও ফ্লাইট শুরু হওযার পর ধীরে ধীরে যাত্রী সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাবার পর পর্যটকদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। গতকাল ১৭ আগস্ট থেকে সরকারি স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিয়ে সকল হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের প্রাণকেন্দ্র দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশই নিজেদের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে কোভিড-১৯ কালীন সময়ে পর্যটকদের নিরোৎসাহিত করছে। ট্যুরিস্ট ভিসা পুরোপুরিভাবেই বন্ধ রেখেছে দূতাবাসগুলি। এ অবস্থা চলতি বছরের বাকী সময় থেকে আগামী বছরও স্থায়ী হতে পারে। সব কিছুই নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উপর। সেই সঙ্গে ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে সরকার কাজ করছে। বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে সরকার ব্যবসা বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। সরকার আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ খাতকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বর্তমানে তৈরি হওয়া পর্যটক শ্রেণিকে দেশীয় পর্যটনে উদ্বুদ্ধ করতে সারাদেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠা পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে। বিশেষ করে কক্সবাজারের পাশাপাশি সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, ইনানী বিচসহ সব দর্শনীয় স্থানসমূহ। সিলেটের চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, মাধবকুন্ডের জলপ্রপাত, পাহাড়, ঝর্ণা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার রয়েছে সীমান্তঘেঁষা বিস্তীর্ণ সবুজ অঞ্চল। ঐতিহ্যময় বাংলার সৌন্দর্য সুন্দরবন, বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগর, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পস্টসহ সারাদেশের আকর্ষণীয় সব পর্যটনকেন্দ্রগুলিকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। পর্যটকদের সামনেও দেশকে চেনার-জানার একটি সুযোগ চলে এসেছে করোনা মহামারির কারণে।

বিগত একদশক ধরেই বাংলাদেশের একশ্রেণির পর্যটক যারা প্রতিবছর ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায় পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যায়। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশীয় পর্যটকরা দেশের বাইরে ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বিভিন্ন দেশের নিয়মনীতির কারণে। আবার অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করবে না বিদেশ ভ্রমণে। এ সময়টায় দেশীয় পর্যটকদের অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজমের প্রতি আকৃষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনাভাইরাস পর্যটন শিল্পের জন্য একটা ব্রেকথ্রু হওয়ার আশঙ্কা আছে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে দেশীয় পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পরিণত করতে হবে। তাই ২০২১ সাল হোক দেশীয় পর্যটন শিল্পের জন্য স্মরণীয় করে রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স লিমিটেড

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন