শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আইএস গোয়েন্দা বিভাগ বিশ্বব্যাপী হত্যার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে

প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন-২
ইনকিলাব ডেস্ক : দু’বছর আগে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের সময় থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘এমনি’ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে। জিজ্ঞাসাবাদের রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘এমনি’ প্রতিষ্ঠার আসল উদ্দেশ্য ছিল গুপ্তচরদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধান করাসহ আইএস সদস্যদের উপর পুলিশি দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৫ সালে গ্রেফতার ফরাসি সদস্যরা ব্যাখ্যা করেন যে ‘এমনি’র নতুন দায়িত্ব হচ্ছে বিদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করা।
গত বছর সিরিয়ায় আইএস ত্যাগ করার পর ফরাসি নাগরিক ৩২ বছর বয়স্ক নিকোলাস মরিউ ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এমনি’ ইসলামিক স্টেটের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং তাদের নিয়োগকৃত যোদ্ধাদের বিদেশে প্রেরণের বিষয়টিও দেখে। ‘এমনি’ তিউনিসিয়ার তিউনিসের জাদুঘরে হামলা বা বেলজিয়ামে ব্যর্থ করে দেয়া ষড়যন্ত্রের মত সহিংস হামলা চালানোর জন্য হামলাকারী প্রেরণ করে।
মরিউ বলেন, তিনি রাক্কায় একটি রেস্তোরাঁ পরিচালনা করতেন। সেখানে তিনি ‘এমনি’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের খাবার সরবরাহ করতেন। তাদের একজন ছিলেন প্যারিস হামলার নেতা আবদেল হামিদ আবাউদ যিনি এ ঘটনার কয়েকদিন পর পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
স্যাফ্রোর বক্তব্যসহ অন্যান্য জিজ্ঞাসাবাদ থেকে তদন্তকারীদের সিদ্ধান্ত যে ‘এমনি’ গত বছর জুনে তিউনিসিয়ার সুসি সমুদ্র সৈকতে গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তি ও ব্রাসেলস বিমান বন্দরে বোমা হামলাকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে হামলা করতে পাঠিয়েছিল।
ফরাসি, অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামের গোয়েন্দা রেকর্ডে দেখা যায় যে ‘এমনি’ তার নিয়োগকৃত ২৮ জন হামলাকারীকে ইসলামিক স্টেটের মূল ভূখ-ের বাইরে মোতায়েন করতে সক্ষম হয়। তারা সফল হামলা যেমন চালায় তেমনি তাদের কিছু ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেও দেয়া হয়। কর্মকর্তারা বলেন, ‘এমনি’র কয়েক ডজন এজেন্ট বিভিন্ন দেশে ঢুকে পড়েছে এবং সিøপার সেল গঠন করেছে।
‘এমনি’র সাথে তার নিজের কর্মকা- প্রসঙ্গে স্যাফ্রোর উপলব্ধি হল তারা সন্ত্রাসবাদের বিশ্বব্যাপী তৎপরতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের গর্তগুলো পূরণের দিকে নজর দিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আইএসের একটি অবকাঠামো তৈরিতে গ্রুপের কাজ সম্পর্কে তাকে বলা হয়। ঢাকায় একটি ক্যাফেতে গত মাসে আইএস বন্দুকধারীদের এক অবরোধের ঘটনায় ২০ জন জিম্মি নিহত হয় যাদের প্রায় সবাই বিদেশী।
স্যাফ্রো বলেন, এশিয়ায় যোদ্ধা নিয়োগে আইএস সুনির্দিষ্টভাবে ঐ অঞ্চলে আল কায়েদার নেটওয়ার্কের সদস্য জঙ্গিদের প্রতি গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আল-কায়েদার পক্ষে কাজ করা লোক রয়েছে। তারা একবার ইসলামিক স্টেটে যোগদান করলে তাদের অভিজ্ঞতা ও কারো সাথে তাদের কোনো সংযোগ আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়।
জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে বক্তব্যে ও এ সপ্তাহে দেয়া সাক্ষাতকারে স্যাফ্রো এ সম্ভবনার কথা তুলে ধরেন যে সম্প্রতি ইউরোপে হামলা চালানো হামলাকারীরা হামলার সময় আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলেও কর্মকর্তাদের ধারণার বাইরে তাদের আরো সরাসরি সংযোগ রয়েছে।
স্যাফ্রো বলেন, ‘এমনি’ তার অনেক সদস্যকে ইউরোপে গোপন অবস্থায় রেখেছে। তারা সংযোগবিন্দু হিসেবে কাজ করে যারা প্রচারণার মাধ্যমে আকৃষ্ট হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত আত্মঘাতী হামলাকারীদের দূর থেকে সক্রিয় করে। তাদেরকে নির্দোষ ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে স্যাফ্রো বলেন, তারা ইসলামে নতুন ধর্মান্তরিত এবং কোনো উগ্রপন্থী গ্রুপের সাথে সম্পর্কহীন। তিনি গোপন সদস্যদের সম্পর্কে বলেন, এসব লোক এসব হামলাকারীদের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত থাকে না, কারণ তারা জানে এসব লোক যদি কথা বলতে শুরু করে তাহলে তারা ধরা পড়বে।
গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাফ্রো একমত যে আইএস তাদের নিয়োগকৃতদের অধিকাংশকে তাদের জাতীয়তার ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে আক্রমণের পরিকল্পনা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। স্যাফ্রো বলেন, একমাত্র যে অঞ্চলটিতে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হামলাকারী পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে সে অঞ্চলটি হচ্ছে উত্তর আমেরিকা। ‘এমনি’র সদস্যরা তাকে এ কথা বলেছে বলে তিনি জানান।
যদিও কয়েক ডজন আমেরিকান আইএসের সদস্য হয়েছে এবং তাদের কয়েকজনকে বৈদেশিক কর্মকা- শাখায় নিয়োগ করা হয়েছে, তারা জানে যে একবার তারা সিরিয়ায় চলে আসার পর আমেরিকায় তাদের জন্য আমেরিকান লোক পাওয়া কঠিন।
প্রশিক্ষণের দিনগুলো
গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাফ্রোর ভাষ্যমতে, ২০১৪ সালের শেষদিক থেকে আইএস তাদের সাথে যোগদানকারী বিদেশীদের নির্দেশ দেয় যে তারা যেন এমন ব্যবস্থা করে যাতে তাদের সফরকে দক্ষিণ তুরস্কে অবকাশ যাপনের মত দেখায়। যেমন তাদের টিকেট হবে রিটার্ন ফøাইেেটর এবং একটি সমুদ্র সৈকতে অবকাশ কাটানোর সব ব্যয় তারা আগাম পরিশোধ করবে যেখান থেকে পাচারকারীরা তাদের সিরিয়ায় প্রেরণের ব্যবস্থা করবে।
এই উপরি আবরণের আড়ালে তারা দ্রুত সিরিয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছে এবং কয়েকদিনের মৌলিক অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ নেয়। তারপর তারা যখন ফ্রান্স বা জার্মানিতে ফিরে গেছে তখন বলেছে যে আমরা তো তুরস্কে ছুটি কাটিয়েছি। তারা বেশিদিন সিরিয়ায় অবস্থান করলেই পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহ হত। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
স্যাফ্রোর সুবিধা যে তিনি জার্মান ও ইংরেজি দু’ভাষাই জানেন। তিনি ইস্ট লন্ডনের নিউহ্যাম কলেজে নির্মাণ বিষয়ে পড়েছেন। এ দু’ভাষা জানা তাকে একজন সম্ভাব্য আকর্ষণীয় হামলাকারীতে পরিণত করে। যদিও ‘এমনি’ তাকে কয়েকবার জার্মানিতে ফিরতে বলে কিন্তু তিনি রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ৬ ফুট ১ ইঞ্চি দীর্ঘ স্যাফ্রোকে আইএসের কুয়াত খাস বা বিশেষ বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়।
জার্মান বন্ধুর সাথে তাকে পাঠানো হয় রাক্কার বাইরে। তাদের যেখানে ছাড়া হয় সেখানে চারপাশে গুহা সদৃশ বাসস্থান দেখা যাচ্ছিল। মাটির উপর সব কিছুতেই মাটির আচ্ছাদন। ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা পেতে এ পন্থা অবলম্বন করেছে আইএস। সেখানে গোসল ছিল নিষিদ্ধ। তারা না দেয়া পর্যন্ত খাবার পাওয়া যেত না। স্যাফ্রো বলেন, একটি গুহার মধ্যে তারা ৫-৬ জন থাকতেন। পানি পান ছিল কঠোর রেশনিংয়ের আওতাধীন। প্রতিটি গুহায় দিনে দু’কাপ পানি দেয়া হত। তা রাখা হত দোরগোড়ায়। উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষা করা, কে পানি খেতে চায়, কে চায় না।
নির্মম প্রশিক্ষণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দৌড়, লাফানো, ঝাঁপ দেয়া, প্যারালাল বার, ক্রলিং অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় সপ্তাহে তাদের প্রত্যেককে কালাশনিকভ রাইফেল দেয়া হয়। দু’পায়ের মাঝে অস্ত্র সাথে নিয়ে ঘুমাতে বলা হয় যতক্ষণ না তা তৃতীয় হাতের মত হয়ে ওঠে।
স্যাফ্রো শুনেছিলেন যে বিশেষ বাহিনীর কর্মসূচিতে প্রশিক্ষণের ১০টি পর্যায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি লেভেল ২-এ স্নাতক হওয়ার পর তাকে সিরিয়ার তাকবা নদীর তীরে একটি দ্বীপে পাঠানো হয়। সেখানে তাদের লাঠি ও ডালপালা ছাওয়া মাটির গর্তে ঘুমাতে হত। তারা সাঁতার, স্কুবা ডাইভিং ও তারা দেখে দিক নির্ণয় করা শেখেন।
প্রশিক্ষণের সময় তার সতীর্থরা ছিল বিভিন্ন দেশের। তিনি মরক্কো, মিসরীয়দের সাথে দৌড়াতেন। তাদের সাথে অন্যূন একজন ইন্দোনেশীয়, একজন কানাডীয় ও একজন বেলজীয় ছিল। তিনি জয়শ আল খলিফা নামে আরেকটি বিশেষ বাহিনীর কথা শুনতে পান। তারাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল।
আইএস জয়শ আল খলিফা বাহিনীতে একজন আমেরিকানকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। এ যুবকটি ছিলেন ভার্জিনিয়ার আলেকজান্দ্রিয়ার ২৬ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ জামাল খেইশ। তিনি ডিসেম্বরে সিরিয়ায় আসেন। মার্চে ইরাকে কুর্দিদের হাতে আটক হন। এফ.বি.আইকে তিনি বলেন, তাকে ঐ বাহিনীতে যোগ দিতে বলা হয়। তারা বলে, প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বদেশে অভিযান ও হামলা চালানোর জন্য তাকে ফেরত পাঠানো হবে।
উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি
বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় স্যাফ্রো ক্যাম্পের আমির একজন মরক্কোর নাগরিকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তিনি তাকে আইএসের বিদেশী কর্মকা- পরিচালনা সম্পর্কে অনেক কথা জানান। স্যাফ্রো তখন জানতে পারেন যে আইএসের কৌশল ও লক্ষ্যের পিছনে এক বড় মাপের ব্যক্তি রয়েছেন। সব কিছুর পিছনে থাকা সে ব্যক্তিটি হলেন আবু মুহাম্মদ আল আদনানি।
স্যাফ্রো বলেন, তিনি হচ্ছেন ‘এমনি’র প্রধান, একইসাথে বিশেষ বাহিনীরও প্রধান। সব কিছুই তার আওতাধীনে।
উত্তর সিরিয়ার বিনিশ শহরে জন্মগ্রহণকারী আদনানির বয়স ৩৯ বছর বলে মনে করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তাকে হত্যা বা আটকের জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। তবে তার জীবন রহস্যাবৃত। তার কয়েকটি মাত্র ছবি পাওয়া যায়। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ তাদের ওয়েব সাইটে তার যে ছবি দিয়েছে তা কয়েক বছর আগের।
স্যাফ্রো বলেন, বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা যখন তাদের প্রশিক্ষণের ১০টি পর্যায় সম্পন্ন করে তখন তাদের চোখ বেঁধে আদনানির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা তার প্রতি সরাসরি আনুগত্য প্রকাশ করে। তারা যতক্ষণ সেখানে থাকে ততক্ষণ তাদের চোখ বাঁধা থাকে যাতে আদনানির সুপ্রশিক্ষিত যোদ্ধারা তিনি দেখতে কেমন তা জানতে না পারে।
বিশ্বের কাছে আদনানি আইএসের সরকারী মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। এ বছর তিনি মুসলমানদের যে যেখানে আছে, যে যেভাবে পারে অবিশ্বাসীদের উপর হামলা চালানোর ডাক দেন।
আইএসের নেতৃত্বের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখা ওয়াশিংটনের ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্র্যাসিস-এর সিনিয়র ফেলো টমাস জোসেলিন বলেন, আদনানি আইএসের মুখপাত্রের চেয়েও বেশীকিছু। তিনি বৈদেশিক কর্মকা-ের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত। তিনি আক্রমণের পরিকল্পনায় স্বাক্ষর দান করেন।
সিরিয়ায় থাকা কালে স্যাফ্রোর সাথে অন্যান্য জার্মান যোদ্ধারা যোগাযোগ করেন। তারা চাইছিলেন যে তিনি জার্মান ভাষীদের উদ্দেশে নির্মিতব্য একটি ফিল্মে অভিনয় করুন। তাদের পালমিরায় নেয়া হয়। স্যাফ্রোকে আইএসের একটি কালো পতাকা হাতে ধরে ক্যামেরার সামনে দিয়ে বারবার যাওয়া-আসা করতে বলা হয় যাতে ছবিটি টেক করা সহজ হয়। এ ছবিতে সিরীয় বন্দীদের হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয় এবং অন্য জার্মান যোদ্ধাদের দ্বারা তাদের গুলি করে হত্যার দৃশ্য দেখানো হয়। সূত্র দি নিউইয়র্ক টাইমস। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন