করোনার মধ্যে অর্থনীতির সব সূচকই ঘুরে দাড়াচ্ছে। ঈদের পরও রেমিট্যান্স উর্ধ্বগতিতে রয়েছে। এরই ফলসরূপ রিজার্ভ ইতোমধ্যে ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক। এর আগে কখনই এত রিজার্ভ ছিলো না। রেমিট্যান্সই উর্ধ্বগতিতে নয়; করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে রফতানি খাতও। শুধু তা-ই নয়, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি খাত আমদানি। করোনা আসার আগে থেকেই এই খাত স্থবির অবস্থায় ছিল। বর্তমানে এই খাত শুধু সচলই হয়নি, করোনার মধ্যে আমদানি খাতে রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৮০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক মে মাসের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের জুন মাসের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। যদিও আগের মাস মে’তে আমদানি কমার হার ছিল ৩১ শতাংশ। মে মাসে ৩৫৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। তার আগের মাস এপ্রিলে হয়েছিল মাত্র ২৮৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের, যা এক মাসের হিসাবে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার আগেও বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেকটা স্থবিরতা ছিল। তবে করোনার শুরুতে এই স্থবিরতা ভয়াবহ রূপ নেয়। গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এই বছরের এপ্রিল মাসে আমদানি কমার হার ছিল ৪৪ শতাংশ। গত বছরের মার্চের তুলনায় এই বছরের মার্চে আমদানি কমার হার ছিল ১৩ শতাংশ।
সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৫৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনে সব ধরনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। অথচ সেই সময়ের চেয়ে এই বছরের জুনে ১০০ কোটি ডলার বেশি আমদানি হয়েছে। গত বছরের জুনে আমদানি হয়েছিল ৩৮৮ কোটি ডলার।
আমদানি বাণিজ্য সচল হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, রফতানি বাড়ার সঙ্গে আমদানি বাড়ারও যোগসূত্র আছে। কারণ, রফতানির বড় অংশই আমদানি নির্ভর। গার্মেন্টস খাতের কাঁচামালের বড় অংশ আসে আমদানি থেকে। ফলে রফতানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানিও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির মধ্যে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের (২০২০-২০২১) প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের (২০১৯ সালের স্বাভাবিক সময়ে) একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় বেশি হয়েছে অন্তত ৩ কোটি মার্কিন ডলার। শুধু তা-ই নয়, রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তার চেয়েও ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব মতে, করোনার প্রভাবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চ মাসে পণ্য আমদানি কমার হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। মার্চ মাসে বাণিজ্যিক পণ্য, রফতানিমুখী ও দেশীয় শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে মোট ৪২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি হয়েছিল ৪৬ হাজার ৯১১ কোটি টাকার।
মার্চ মাসে ৪২৭ কোটি ৭২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল ৪৭২ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের। জানুয়ারিতে হয়েছিল ৫৩৩ কোটি ৪১ লাখ ডলারের। ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৫২৫ কোটি ৪২ লাখ ডলারের পণ্য।
জানা গেছে, করোনার এ সময় স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। অপ্রয়োজনীয় খরচও কমিয়ে দিয়েছেন তারা। তবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফল খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন কমবেশি সবাই। এ কারণে ফল আমদানি বেড়ে গেছে। আমদানির তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে জুন এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশি ফলের আমদানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। মার্চ থেকে জুন এই করোনাকালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আপেল আমদানি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। একইভাবে কমলা, আঙ্গুর, নাশপাতি, ডালিম আমদানি বেড়েছে ৯২ শতাংশ।
বিদেশি ফলের আমদানি বাড়ায় বৈশ্বিক আমদানির তালিকায়ও উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। তথ্য বলছে, আপেল আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। পণ্যের বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী, মাল্টা আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পঞ্চম। তিন বছর আগে ছিল অষ্টম অবস্থানে।
দেশের ফল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশি ফলের দাম এখন মানুষের হাতের নাগালে। এ কারণে ফল খাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বর্তমানে ১০০ টাকা দিয়েও এক কেজি আপেল কেনা যায়। আবার মাল্টাও বছরের বেশিরভাগ সময় কেজিপ্রতি ১২০ টাকায় বেচাকেনা হয়। অবশ্য এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আপেল ও মাল্টা ১৫০ টাকা কেজির বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফল আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিদেশি ফলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা ও রোজা মিলিয়ে এবার ফল আমদানি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) দেশের বাজারে পাম অয়েল, সয়াবিন তেলসহ সব ধরনের ভোজ্যতেল ও চর্বি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে দেশের বাজারে সব মিলিয়ে ১৬ লাখ ৪ হাজার ২৪৩ টন ভোজ্যতেল ও চর্বি আমদানি হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের বাজারে সব মিলিয়ে ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৪০৩ টন ভোজ্যতেল ও চর্বি আমদানি হয়েছিল। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশীয় আমদানিকারকরা ভোজ্যতেল ও চর্বি আমদানি বাড়িয়েছেন ৭৩ হাজার ৮৪০ টন।
আমদানি করা এসব ভোজ্যতেল ও চর্বির মধ্যে প্রধান তিনটি পণ্য সয়াবিন তেল, পাম অয়েল এবং ক্যানোলা বা সরিষা তেল। গত ছয় মাসে দেশের বাজারে মোট ভোজ্যতেল আমদানির ৮৩ শতাংশ ছিল এ তিনটির দখলে।
তথ্য বলছে, আগের বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৮০ টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে দেশে মোট ৬ লাখ ৯১ হাজার ৯০৫ টন পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল।
অবশ্য আগের বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে সয়াবিন আমদানির পরিমাণ কমেছে ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে দেশে মোট ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩২৫ টন সয়াবিন আমদানি হয়েছিল। চলতি বছরের একই সময়ে ভোজ্যতেলটির আমদানির পরিমাণ ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৩০১ টন। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে দেশে সয়াবিন তেল আমদানি ৬৯ হাজার ২৪ টন কমলেও পাম অয়েল আমদানি বেড়েছে ৫৪ হাজার ৩৭৫ টন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন