বিদায়ী অর্থবছর (২০১৯-২০) শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। তার আগের অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ, দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মাথাপিছু আয়ের সাময়িক হিসাবে এই চিত্র উঠে এসেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি মুদ্রায় মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে দাঁড়াচ্ছে গড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মাসে গড় আয় প্রায় ১৪ হাজার ৬০০ টাকার মতো।
মাথাপিছু আয় বেশি মানেই যে কোনো দেশ খুব ভালো আছে তা কিন্তু নয়। একজন দুর্নীতি করে মাসে আয় করে ১ লাখ টাকা, আর একজন কষ্ট করে আয় করে মাসে ১০ হাজার টাকা। উভয়ের মাসিক আয় ১,১০,০০০ হাজার টাকা। গড় আয় ৫৫,০০০ হাজার টাকা। এটাই হলো বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের হিসাব। এই হিসাবে বিবিএস তো মিথ্যা বলছে না। সুতরাং এখানেই আয়বৈষম্যের বিষয়টি চলে আসে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন আরও অনেক বড় বিষয়। তরুণদের বেকারত্ব দেশের অন্যতম জ্বলন্ত সমস্যা, যা বড়ই উদ্বেগের বিষয়। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে ২০২০ সালের মধ্যে কাজ ও পড়াশোনা কোনোটিই করেন না, এমন তরুণ-তরুণীর হার ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কী হবে এই ‘উচ্চাভিলাষী’ দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধি নিয়ে, যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিষাক্ত নগরী হয় ঢাকা, পরিবেশ দূষণে শীর্ষ দেশ যদি হয় বাংলাদেশ, শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে একটি যদি হয় দেশ, বেকারদের সংখ্যা যদি ক্রমেই বাড়তে থাকে আর বেকারত্বের যন্ত্রণা নিয়ে কেবল বেঁচে থাকার আশায় দুর্গম পথ আর সাগর পাড়ি দিয়ে অপমৃত্যুকেই বরণ করতে হয়?
কিছু সত্য সব সময় বড্ড তেতো হয়। তা হলো- টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, হরিলুট, এত কিছুর পরও কিভাবে জিডিপি বাড়ে? কারণ, অর্থনীতিতে লেনদেন বাড়লেই জিডিপি বাড়ে। সেই অর্থে ঘুষের লেনদেন, রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ বা ফ্লাইওভার নির্মাণে যতই লুটপাট হোক; এমপি, নেতা, ঠিকাদার মিলে যতই ভাগ-বাটোয়ারা করুক, যতই লাফিয়ে লাফিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়ুক, টাকার লেনদেন বাড়লেই জিডিপিও বাড়বে। ইতিপূর্বে গ্লােবাল কম্পেটিটিভ ইনডেক্স বলছে, এশিয়ার মধ্যে নেপালের পরেই সবচেয়ে খারাপ রাস্তা বাংলাদেশে। অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ/ তিনগুণ অর্থ ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলেও কয়েক বছরের মাথায় পুনর্নিমাণ করার প্রয়োজন পড়ছে। অর্থাৎ আবারও নতুন বাজেট, নতুন লেনদেন, নতুন ভাগ-বাটোয়ারা, নতুন চুরি। এভাবে প্রকল্প ব্যয় বা চুরির পরিমাণ বাড়লে জিডিপি বাড়াই স্বাভাবিক। কারণ, জিডিপি কেবল ‘ফাইনাল প্রোডাক্টে’র মূল্যমান বোঝে। কে পেল টাকার ভাগ- নেতা, জনগণ না ঠিকাদার, সেই হিসাবের দায় জিডিপির নেই। দুর্নীতির টাকা যতক্ষণ দেশে থাকবে এবং দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হলে তাও মন্দের ভালো। কিন্তু বিদেশে পাচার কেন হচ্ছে? তার কারণ, যারা নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে, তাদের রয়েছে ভবিষ্যতের শঙ্কা, রাজনৈতিক শঙ্কা, দেশের নিম্ন জীবনমানে অনাগ্রহ, আর সবচেয়ে বড় কথা দেশপ্রেমের অভাব। দেশ রসাতলে যায় যাক, স্বপরিবারে এক সময় বিদেশ পাড়ি দিতে পারলেই হলো।
না খেয়ে, ক্ষুধার্থ থেকে কেউই সুন্দর বা উন্নয়নশীল দেশ চাইতে পারে না। আগে মানুষ খেতে চায়, পরতে চায়, নিরাপত্তা চায়। কার আমলে মানব উন্নয়ন সূচক কত বেড়েছে তা সাধারণ মানুষের দেখার বিষয় নয়। কে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলো তাও সাধারণের জেনে লাভ নেই। জনগণ সারাদিন খেটে দু মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে, আর নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সিপিডির ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬ বছরে জিডিপি বাড়ার দিনগুলোয় সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা, আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১০৫৮ টাকা। এখনো মানুষ অভাব অনটনে জর্জরিত হয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে, পরিবারের মায়া ত্যাগ করে একটু স্বচ্ছলতার আশায় নিজের জীবনকে বাজি রেখে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। এখনো দেশের অনেক মানুষ তিন বেলা পেটপুরে খেতে পায় না। ডিগ্রি বা মাস্টার্স পাশ হকার বা ফেরিওয়ালা বেশুমার। খাদ্যের অভাবে মা সন্তানের মুখে বিষ ঢেলে নিজেও বিষপান করছে, রেল লাইনে ঝাঁপ দিচ্ছে।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সুসমভাবে হচ্ছে কিনা সেদিকে আলোকপাত করা দরকার। কারণ, ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলথ এক্স ইনস্টিটিউট নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে তার প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানিয়েছে, বিশ্বে ধনী তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে তালিকায় বাংলাদেশ সবার ওপরে। টপকে গেছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশকে। তাদের মতে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অতি ধনী বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এখানে অতি ধনী বলতে তাঁদের বুঝিয়েছে, যাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকা। নানা পরিসংখ্যানে প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশও একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ। আর এই আয়বৈষম্যের কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনমান উন্নত করার সুযোগ থেকে পিছিয়ে থাকছে গরিব পরিবারগুলো। মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি খুবই আশার কথা। বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে আশ্চর্য রকম উন্নতি করেছে। প্রবৃদ্ধির হিসাবে অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ফলে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সব মানুষ লাভবান হয়নি।
করোনা বদলে দিয়েছে মানুষের জীবন। গত মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধসহ ব্যক্তিগত গাড়িও চলেছে সীমিত আকারে। আকাশে ডানা মেলেনি বিমান। মানুষও প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে খুব একটা বের হয়নি। সব মিলিয়ে প্রায় চার মাস অর্থাৎ অর্থবছরের তিন ভাগের এক ভাগ সময় দেশ কার্যত অচল ছিলো, যাতে বেশিরভাগ মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে, কারো কারো একেবারে বন্ধ হয়ে গেসে। গরিব আর মধ্যবৃত্তরা উপলব্ধি করছে জীবন কত কষ্টের। এরই মধ্যে মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় বাড়ার খবর দিয়েছে বিবিএস। যদিও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জিডিপির হিসাব মিলছে না। সব রকম যানবাহন বন্ধ, পর্যটনশিল্প, হোটেল রেস্তোরাঁ, নির্মাণ খাত, বেসরকারি বিনিয়োগ, বেশির ভাগ কলকারখানা সাময়িক বা নির্দিষ্ট সময় বন্ধ থাকলে জিডিপির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, এমন কোনো সমীক্ষা বিবিএসের নেই। অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে গিয়েছিল। ফলে ক্ষয়ক্ষতি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে না পারায় বিবিএসের প্রবৃদ্ধির হিসাবটি প্রশ্নবিদ্ধ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। মূলত বর্তমান সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাথাপিছু আয়ের হিসাব, যা শুভংকরের ফাঁকি। এই হিসাবে সোনালী, জনতা, ফার্মার্স ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হল-মার্ক, যুবক, এমনকি শেয়ারবাজার লুটেরাদের কুক্ষিগত সম্পদকেও সমাজের দশজনের গড় সম্পদ বলে হিসাব করা হয়। এতে হকার, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বেকার সবাইকে মধ্যবিত্ত দেখায়। আর মাঝখান থেকে লুটেরাদের ফুলে-ফেঁপে ওঠার দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে যায়। নানা অপকৌশলে কিছু লোক শুধু শুধু টাকা পায়, আর কিছু লোক টাকা হারায়! বিদেশিরা নিজের পরিশ্রমে ধনী হয়, আর বাংলাদেশে শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের যথাযথ পারিশ্রমিক না দিয়ে ধনী, শুধু এটুকুই পার্থক্য! মাথাপিছু এই গড় আয়বৃদ্ধির মাথাগুলো দেশের সর্বসাধারণের নয়। মাথাগুলো হলো পাপিয়া, শাহেদ, সম্রাট, রন হকদের। কতিপয় ক্যাসিনো ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতিবাজ, ভেজাল দ্রব্যের ব্যবসায়ী, ফুটপাত দখলদারদের আয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় গণনা করলেতো হবে না। সরকারের পক্ষ থেকে বিবিএস প্রতিবছর যেভাবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মাথাপিছু আয়ের সাময়িক হিসাব করে থাকে, তেমনিভাবে ঘুষ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির প্রবৃদ্ধির হিসাবও করছে না কেনো?
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়া জাতির জন্য বিরাট অর্জন হলেও একই সঙ্গে এটি হবে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বড় অর্জনে চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি। আলোর উল্টোপাশেই যেমন অন্ধকারের বাস, তেমনই এই সুসংবাদের উল্টোপিঠে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে দেশকে। দেশ এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখনো বাংলাদেশের বাজেটে আয় হিসেবে বিপুল অংকের বৈদেশিক ঋণের কথা উল্লেখ করতে হয়। তারপরও এখন থেকে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে বাংলাদেশ তার সুফল নিতে পারবে। এমন লাখো মানুষ রয়েছেন, যাদের একমাসের বেতন দিয়ে পনের দিনও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। এছাড়া পরের দেশে কামলা না খাটলে আমাদের অনেকের ফ্যামিলি না খেয়ে থাকতো। গুটিকয়েক মানুষ নয়-ছয় করে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। আর সেগুলোই মাথাপিছু আয় হিসাবে দেখিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা নেয়া হচ্ছে। যদি বলতেই হয় উন্নয়ন হচ্ছে, তাহলে বলতে হবে কিছু অসাধু লোক সম্পদের পাহাড় গড়েছে। ফলে বৈষম্য অনেক বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় কি একশ্রেণির শুধু সম্পদ বাড়বে, আর গরিবরা চিরকাল গরিবই থেকে যাবে? স্বাধীনতা পরবর্তী গত পাঁচদশকে আমার আরো বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি আমরা দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম! মাথাপিছু আয় বাড়ার খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। সরকারকে আয়ের বৈষম্যের ব্যাপারটিও লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সুষম সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সাথে সাথে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, এটাই আমাদের কামনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন