করোনাভাইরাসের প্রভাবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দুবাই, আবুধাবিসহ মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোয় চালু হয়েছে বিমান। এর পরই মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের বিমান টিকিট নিয়ে হাহাকার দেখা দিয়েছে। বিমানের ঢাকা অফিসে টিকিটপ্রত্যাশীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর মতিঝিলে বিমান অফিসে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের টিকিট পেতে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। টিকিট না পেয়ে বেশির ভাগই বাইরে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। হাতে গোনা কয়েকজন টিকিট পেলেও অধিকাংশ যাত্রীই ফিরেছেন খালি হাতে। অভিযোগ উঠেছে, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে বিমানের টিকিট। যাত্রীরা বিমান অফিসে গিয়ে টিকিট না পেলেও দালালদের মোটা অঙ্কের টাকা দিলে মিলছে টিকিট। কয়েক দিন ধরে ৩৮ হাজার টাকার টিকিট বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। একই অবস্থা চট্টগ্রাম ও সিলেটেও। অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার বলেন, টিকিটের কৃত্রিম সংকটের কোনো সুযোগ নেই বিমানে। কোনো সিন্ডিকেটও নেই। চাহিদার তুলনায় কম ফ্লাইট হওয়ার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
করোনাকালে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটিতে আসা প্রায় ৫ লাখ প্রবাসী কর্মী আটকা পড়েছেন। এর মধ্যে শুধু সউদী আরব থেকেই ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছেন প্রায় সোয়া লাখ কর্মী। আটকে পড়া এসব প্রবাসী কর্মীর উপার্জনের সাথে আরো ২০ লাখ লোক জড়িত। প্রবাসে স্ব স্ব কর্মস্থলে ফিরতে না পারায় প্রতি মাসে এসব কর্মী দশ থেকে পনেরো মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে লকডাউন শিথিল হলেও ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ না নেয়ায় এসব প্রবাসী কর্মী কর্মস্থলে ফিরতে পারছে না। যথাসময়ে কর্মস্থলে ফিরতে না পারলে এদের অনেকেই চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। এ প্রসঙ্গে বায়রার যুগ্ম মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আটকে পড়া লাখ লাখ প্রবাসী কর্মীর চাকরির নিরাপত্তায় সরকারের দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের চাকরি যাতে বহাল থাকে, ভিসার মেয়াদ যাতে অটো বাড়ানো হয় এবং নিয়োগকর্তার অনুমতিক্রমে কর্মস্থান পরিবর্তন করতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকে মিশনগুলোর মাধ্যমে জোড়ালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। যেসব রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু হয়েছে টিকিটের সঙ্কট কাটাতে সেগুলো বাড়াতে হবে।
মতিঝিলে বিমান অফিসের আবুধাবীর টিকিটের জন্য ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে এসেছিলেন মো. লাল মিয়া (৩২)। গতকাল বুধবার তার সাথে কথা হয়। তিনি জানান, জানুয়ারির ১৩ তারিখে দেশে এসেছি। গত ২৯ মে আবুধাবীতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। এপ্রিল মাস থেকে টিকিট নিশ্চিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। গতকাল ভোর ৪টায় রওনা করে মতিঝিল বিমান অফিসে এসেছেন। লালমিয়া বলেন, আমাকে বিমান অফিস থেকে জানানো হয়েছে, আবুধাবীর ফ্লাইট বন্ধ। আগামী ৩১ আগস্টের পর জানা যাবে কবে ফ্লাইট হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ১২ বছর ধরে আবুধাবীতে আছি। সেখানকার কোম্পানী আমাকে চাচ্ছে। কিন্তু ফ্লাইটের অভাবে যেতে পারছি না। তারা তো দুই মাস অপেক্ষা করলো আমার জন্য। আর কতো অপেক্ষা করবে? শেষ পর্যন্ত চাকরিটা হারাবো।
বিমান অফিসের সামনে সোহেল নামে একজন যাত্রীর সাথে। তার বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরায়। গত ৮ এপ্রিল তার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। তিনি সে দেশ থেকে তিন মাসের ছুটিতে জানুয়ারিতে দেশে আসেন। করোনার কারণে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আর যেতে পারেননি। গতকাল বিমান অফিসে টিকিটের জন্য আসেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তাকে সে দেশে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে বলেন। সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখিয়ে টিকিট নিতে বলেন। তবে তার ওয়ার্কপারমিট এখনো বাতিল হয়নি। তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ কারার চেষ্টা করছেন। মোকাররম নামে আরেকজন জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে দুবাইতে থাকেন। তিন মাসের ছুটিতে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর দেশে আসেন। ২৭ মার্চ তার ফিরতি ফ্লাইট ছিল। তার আগেই ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ফ্লাইট চালু হলে দুবাইতে অনলাইনে ফেডারেল অথরিটি ফর আইডেনটিটি অ্যান্ড সিটিজেনশিপ (আইসিএ) আবেদন সম্পন্ন করেন। সবকিছু ঠিকঠাক। এরপর টিকিটের জন্য বিমান অফিসে আসেন। এখান থেকে তাকে বলা হয় যাদের ছয় মাসের মধ্যে টিকিট ছিল তাদের আগে দেবে। যাদের ছয় মাসের বেশি হয়েছে তাদের নেবে পরে। কিন্তু কবে নেবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি। অথচ দুবাইতে যোগাযোগ করে জেনেছেন, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। এর আগে তারা ১৩ আগস্ট এসেছিলেন টিকিটের জন্য। ওইদিন বলা হয়েছিল পরদিন আসার আসার জন্য। এদিন আসার পর আবার বলছে দুই মাস অপেক্ষার জন্য। সোলায়মান নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, তিনি ১০ বছর ধরে দুবাই থাকেন। দেড় মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। করোনার জন্য আর ফেরত যেতে পারেননি। তার কোম্পানি থেকে বলা হয় ফ্লাইট চালু হলেই ফেরত যেতে। ১৩ আগস্ট বিমান অফিসে এসে জানতে পারেন কোনো আইসিএ অনুমোদন লাগবে না, শুধু করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ হলেই হবে। ওইদিনই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিলে টিকিট নিয়ে যান তিনি। গতকাল রাতে তার ফ্লাইট ছিল। সকালে এসে শোনেন, আইসিএ অনুমোদন লাগবে। যে টিকিট তিনি নিয়েছিলেন তা বাতিল করে দিয়েছে।
ভুক্তভোগি যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, বিমানের অফিসে টিকিট না পেলেও দালালের মাধ্যমে টিকিট মিলছে। তবে সেজন্য দিতে হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি টাক্যা। কয়েক দিন ধরে ৩৮ হাজার টাকার টিকিট বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের অনেকে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট বাড়িয়ে দিচ্ছে টিকিটের দাম।
এদিকে, গত ১৫ আগস্ট আবুধাবি থেকে ফেরত পাঠানো ৬৮ প্রবাসী বিমান অফিসে এসে জানার চেষ্টা করছেন তারা আদৌ যেতে পারবেন কি না? বিমানের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আশরাফুল আমিন মুকুট তাদের আশ্বস্ত করেছেন, পুনরায় তারা যাওয়ার অনুমতি পেলে টিকিটের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। আবুধাবি ফেরত একজন যাত্রী জানান, শুধু তারা নন, এয়ার অ্যারাবিয়া ও এমিরেটসের ফ্লাইটে যাওয়া আরও প্রায় আড়াইশ’ প্রবাসী একই কারণে সেখানে আটকা পড়েছেন।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশের বাইরে কর্মরত আছেন অন্তত ১ কোটি ১৫ লাখ বাংলাদেশি। বিএমইটির তথ্যমতে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ২৬ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন। দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি প্রবাসীদের আয়। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও শুধু গত জুলাই মাসেই ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে এর আগে কখনো এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। প্রবাসীদের আয়ের কারণেই বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্কটাও বেশ মজবুত। দেশের অন্যতম আয়ের উৎস রেমিটেন্স অর্থাৎ প্রবাসীদের উপার্জন। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ডলার, যা টাকার অঙ্কে ৩৬ কোটি টাকা; আর গত বছর রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার, যা টাকার হিসাবে এক লাখ ত্রিশ হাজার কোটি টাকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেমিটেন্সের পরিমাণও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে, টিকিটের একই সমস্যা বিরাজমান সিলেট ও চট্টগ্রামে। টিকিটের কৃত্রিম সংকটে পড়ে হতাশ আটকে পড়া প্রবাসীরা। বাংলাদেশ বিমানসহ বিভিন্ন বিমান সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও মিলছে না কাঙ্খিত টিকিট। যারা পাচ্ছেন তাদেরও স্বাভাবিক সময়ের কয়েকগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে টিকিট। সংকটের কারণে কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি চট্টগ্রামের লাখো প্রবাসী। টিকিটের এ কৃত্রিম সংকটে দেশেই আটকা পড়ছেন প্রবাসীরা। এতে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চাকরি হারানোর শঙ্কা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন