একটি শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা অর্থাৎ ওর পর্যাপ্ত পুষ্টি বৃদ্ধি, বুদ্ধি ও বিকাশের জন্য তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো-১. পর্যাপ্ত খাদ্য, ২. মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুস্থ পরিবেশ, ৩. মা ও শিশুর পরিচর্যা বা লালন পালন।
মাতৃত্ব নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের দেশে নবজাতক শিশু ও প্রসূতিমাতার মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে যে সব শিশু জন্ম নিচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও যত্ন অধিক হওয়া উচিত। অথচ এই দুর্যোগে স্বাভাবিক নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার মান করোনা সংকটে বিপর্যস্ত। ফলে বেড়েছে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের ঝুঁকির মাত্রা। মহামারি করোনার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থা যতই নড়বড়ে হোক, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে।
মা ও শিশুর অকাল মৃত্যুর জন্য বাল্যবিয়ে একটি বড় কারণ। এখনও আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের হার উদ্বেগজনক। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে বাল্যবিয়ে কখনও বন্ধ হবে না। মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে আনার যে পরিকল্পনা সরকারের, সেখানে আমাদের আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ওজিএসবি মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে না কমানোর দাবি করছে দীর্ঘদিন ধরে। এই দাবি যৌক্তিক। আমরা মনে করি, মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে হলে নারীশিক্ষার হার বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। মাতৃত্ব, সন্তান লালন-পালন ও গর্ভকালীন যত্ন সম্পর্কে মায়েদের সচেতন করে তুলতে হবে। সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে হলে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে একজন মাকে সুস্থ থাকতে হবে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে অনেক শিশু অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্ম নেয়। অনাগত শিশুর জীবন যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে সেদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ নজর রাখা উচিত। কোনো প্রসূতির বাড়িতে সন্তান প্রসব যদি অনিবার্যই হয়, তাহলে বাড়িতেই নিরাপদ প্রসব এবং তার আগে ও পরের সেবা পাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের নজরের অভাব গ্রহণযোগ্য নয়। একই সঙ্গে শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।
গত জুন মাসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ‘ল্যানসেট’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আগামী ছয় মাসে শিশু ও মাতৃমৃত্যু বাড়তে পারে। এসব দেশে পরিবার পরিকল্পনাসেবা প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এর ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমবে। বাড়বে অনিরাপদ গর্ভপাত। আর প্রসবপূর্ব ও প্রসবপরবর্তী সেবা কমে যেতে পারে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ করে। আমরা চাই, এই গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি রাখা হোক। বাংলাদেশের শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবার মান অনুন্নত। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্য সেবার প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বরং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে যে বিরোধের দেয়াল তৈরি হয়েছে তাতে আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবার আরও অবনতি হবে বলে আভাস পাচ্ছি। তবে আমরা আশাবাদী থাকতে চাই। আমরা চাই সরকার সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দেশের মানুষের মনে আস্থা জাগাবে। নিরাপদ মাতৃত্ব ও শিশু মৃত্যু হ্রাস করা আমাদের অঙ্গীকার হোক। প্রতিটি জন্মই হোক পরিকল্পিত, প্রতিটি প্রসব হোক নিরাপদ। এই প্রত্যাশা আমাদের।
ডা: মাও: লোকমান হেকিম
শিক্ষক-কলামিস্ট
মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন