পৃথিবীতে প্রাণ বাঁচার কারণ হচ্ছে এখানে রয়েছে প্রচুর বায়ু আর পানির সরবরাহ। আর রয়েছে তাপমাত্রা। আকাশ, বাতাস, গাছপালা, মাটি এবং সূর্যের আলো থেকে প্রতিদিন মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়ে আসছে। এদের কোনটার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটলে পৃথিবীতে মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রকৃতি ও মানব সৃষ্ট বিভিন্ন দূষণ আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের নিয়মকে নষ্ট করে দেয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলে, যা পৃথিবীর গাছপালা ও প্রাণিকূলের জন্ম এবং বৃদ্ধির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরিবেশ দূষণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যথা- বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণ ইত্যাদি। শব্দদূষণ একটি বড় সমস্যা। যখনই শব্দ বিরক্তিকর এবং ক্ষতিকর হয়, তখনই তা দূষণের পর্যায়ে চলে যায়। শব্দদূষণজনিত বধিরতা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এক দিকে যেমন বৃদ্ধি পায় পরিবেশদূষণ, অন্যদিকে তেমনি বৃদ্ধি পায় উন্নত জীবন শৈলীর প্রতি মানুষের সচেতনতা। উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে সাধারণত পরিবেশদূষণ বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হচ্ছে অধিক উৎপাদন এবং ভোগ, যা পরিবেশের উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করে এবং ঘটায় দূষণ। আমরা কথোপকথোনের মাধ্যমে পারস্পরিক ভাব বিনিময় করি। কোনো ব্যক্তির উচ্চারিত শব্দ আমরা আমাদের শ্রুতি কোষের মাধ্যমে শুনতে পাই। কিন্তু আমরা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দ শুনতে পাই, অধিক উচ্চশব্দ ও অধিক নিম্নশব্দ আমরা শুনতে পাই না। শব্দের তীব্রতার উপর নির্ভর করে শব্দদূষণ নির্ণয় করা হয়। শব্দ মাপের একক ডেসিবেল। আমরা ২০ ডেসিবেল থেকে ১২০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ শুনতে পাই। ২০ ডেসিবেলের নিম্নমাত্রার এবং ১২০ ডেসিবেলের উচ্চ মাত্রার শব্দ শুনতে পাই না। তবে মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণমাত্রা ৬০-৭৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ।
শব্দের মাত্রা ৭৫ ডেসিবেল অতিক্রম করলেই সেটা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে। এটা এখন প্রমাণিত যে কেবল বস্তুই পরিবেশ দূষিত করে না, অবস্তুও পরিবেশ দূষণ ঘটাতে পারে যেমন- শব্দ। উচ্চ এবং অবাঞ্চিত কোনো শব্দ, যা পরিবেশের এবং মানুষ বা অন্য কোনো জীবের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট করে তাকেই আমরা শব্দ দূষণ বলে থাকি।
শব্দ দূষণের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে বুঝা যায় না। এটি সাধারণত পরোক্ষভাবে এবং ধীরে ধীরে মানব শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন কারণে শব্দদূষণ হতে পারে, যানবাহনের জোরালো হর্ন, কলকারখানার নির্গত শব্দ, বিভিন্ন নির্মাণ কাজের শব্দ, যানবাহন চলাচলের শব্দ, অনিয়ন্ত্রিত লাউডস্পিকার ব্যবহার, উড়োজাহাজের শব্দ, প্রচন্ড জনকোলাহল ইত্যাদি শব্দ দূষণের মূল কারণ।
গ্রামাঞ্চলেরর তুলনায় শহর এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। শব্দও যে একটি দূষণ এবং মানুষসহ জীব জগতের উপর এর অভিঘাত কত মারাত্মক হতে পারে তা সাধারণ মানুষ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে না। ঢাকা শহরের স্বাভাবিক শব্দের মাত্রা গড়ে ১০০ ডেসিবেলের উপরে। পাথর ভাঙ্গার মেশিন ও জেট বিমানের ইঞ্জিনের শব্দের মাত্রা যথাক্রমে ১২০ ও ১৩০ ডেসিবল। শর্টগানের শব্দের মাত্রা ১৪০ ডেসিবেল। বাজার ও কারখানা, ট্রাক্টর এবং নতুন মোটর গাড়ির শব্দের মাত্রা যথাক্রমে ৯০-১০০ ডেসিবেল, ৬০-৭০ ডেসিবেল এবং ৯৫ ডেসিবেল। অবশ্য শুধু কর্মস্থল বা ঘরের বাইরেই নয়, ঘরে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ফুড ব্লেন্ডার, বাসন ধোয়ায় যন্ত্র, ফুড গ্রাইন্ডার, টেলিভিশন লাউডস্পিকার, পাখা ইত্যাদি থেকেও শব্দ দূষণ সৃষ্টি হতে পারে।
একটা গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে শব্দদূষণের যে মাত্রা, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত তো হবেনই, এছাড়া তাঁদের ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করাসহ হৃদরোগের সমস্যাও হতে পারে। ২০১৬ সালের একটি গবেষণা আছে, সেখানে দেখা গেছে যে, সরাসরি এক তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে কম বা বেশি ক্ষতিও আছে। সবাই যে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনটা নয়। কারো বেশি হচ্ছে, আবার কারো কম ক্ষতি হচ্ছে। তবে ক্ষতি সকলেরই হচ্ছে।
শব্দ দূষণের ফলে মানুষের মানসিক ও শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে। শব্দ দূষণে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন ব্যাহত হয়, শ্রবণশক্তি কমে আসে, এমন কি বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে, শব্দ দূষণের ফলে কণ্ঠনালীর প্রদাহ, আলসার, মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। হঠাৎ উচ্চ শব্দ, যেমন- বোমা বা পটকা ফাটার শব্দ, যানবাহনের তীব্র হাইড্রোলিক হর্ন মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ জাতীয় শব্দ প্রবাহে সাময়িকভাবে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শব্দের তীব্রতা অনুযায়ী বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যেমন বিরক্তিভাব, ক্রোধপ্রবণতা, মানসিক উত্তেজনা, এমনকি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশের মানসিক রোগীদের একাংশের রোগাক্রান্তের কারণ শব্দদূষণ। ফ্রান্সের প্যারিসে ৭০ শতাংশ নিউরোসিস রোগী শব্দদূষণের কারণে ঐ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১০ লক্ষ শিশু রক মিউজিক আসক্ত হওয়ায় শব্দদূষণে বধিরতায় ভুগছে। শব্দদূষণের কারণে গর্ভস্থ সন্তান শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
শব্দদূষণ মানুষ ছাড়াও পরিবেশের অন্যান্য জৈবিক ও অজৈবিক উপাদানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঢাকা শহরে মানুষ ছাড়া অন্য কোন জীব সম্প্রদায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সামান্য কিছু গাছপালা, ছোটখাট পাখি, রাস্তার কুকুর-বিড়াল-ইদুঁর এবং মশা ছাড়া আর কোন জীব-সম্প্রদায় এখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ক্ষুদ্র জীবন্ত সত্ত্বাগুলোর ঢাকা শহরের মারাত্মক শব্দ দূষণের কারণে যে কি অবস্থা তা এক মাত্র বিধাতাই জানেন। আবার, শব্দ যেহেতু এক ধরনের কম্পন, তাই উচ্চ কম্পনের শব্দ পরিবেশের অজৈবিক উপাদানের ভারসাম্যকেও বিনষ্ট করে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে বিভিন্ন যানবাহন ও কলকারখানা থেকে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করা এবং উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী তথা শব্দ দূষণকারী যানবাহন ও কলকারখানার বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা। উন্নত দেশগুলোতে কলকারখানা থেকে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা নিয়মিত পরিমাপের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা অতি জরুরি। ঢাকা মহানগর পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮ এর ২৫ নং অনুচ্ছেদের ছ নং উপ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাস্তা বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন, উচ্চ শব্দযুক্ত সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, ঢাক পেটানো ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণ অথবা নিকটবর্তী বাসিন্দাদের প্রতিবন্ধকতা বা বিরক্তি করতে পারে এমন কাজের জন্য পুলিশ কমিশনার তাৎক্ষণিক গ্রেফতারসহ বিধি মোতাবেক যে কোনো ধরনের শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ এখনও চালু হয়নি। এ আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ দূষণ সংরক্ষণ আইনের ১৫ নং ধারার, ১ উপ-ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি এ আইনের বিধান লংঘন করেন বা এ আইন বা বিধির অধীনে প্রদত্ত নোটিশ অনুযায়ী দায়িত্ব সম্পাদনে বা আদেশ বা নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি অনুরূপ ব্যর্থতার দায়ে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ১.০ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের দন্ডে দন্ডিত হবেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত আইনে শব্দকেও পরিবেশ দূষক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা অতি জরুরি।
আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। রাস্তাঘাটে অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজিয়ে যারা শব্দদূষণ করে তাদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। একজন যখন বুঝবে যে গাড়ির হর্ন সত্যিই ক্ষতিকারক, তখন অন্ততপক্ষে সে অযথা হর্ন বাজাবে না। উচ্চ শব্দের মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণেও সচেতনা জরুরি। আর আমাদের গৃহের শব্দ দূষণ তো নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে এই ক্ষেত্রেও ব্যক্তির সচেতনতাই একমাত্র ভরসা।
লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন