মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ’১৩

প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

‘বন্দুকযুদ্ধ’ ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু’ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শংকা-আতংকের অবধি নেই। এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অভিধানিকভাবে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলতে বুঝায়, দু’টি পক্ষের পরস্পরের দিকে গোলাগুলি ছোড়া। আর প্রচলিত ধারণায় ‘ক্রসফায়ার’ হলো দু’টি পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে হতাহত হওয়া। গত একযুগ ধরে আমাদের দেশে বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের যে সব ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে অভিধানিক অর্থ ও প্রচলিত ধারণার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের পর যে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়, তা গতানুগতিক এবং একই বর্ণনা ও ব্যাখ্যার পুনরাবৃত্তি মাত্র। মানুষের কাছে এই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতিভাত হয় না। অন্যদিকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনাকেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। এ ধরনের হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে দেশের রাজনৈতিক মহল বিদ্বৎসমাজ, দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন লাগাতার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ হচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ তিন বছরে ক্রসফায়ারে ৭৪৬ জন সন্দেহভাজন আসামী নিহত হয়। তখন এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রতি সরকারী মহল থেকে সমর্থন জানানো হলেও বিরোধী রাজনৈতিক মহল বিশেষত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই প্রতিশ্রুতি অবশ্য মহাজোট ও বর্তমান সরকারের আমলে রক্ষিত হয়নি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- অব্যাহত আছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গত তিন বছরের হিসাবে দেখা গেছে, বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারে ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৪৬ জন এবং ২০০৬ সালে ৩০ জুন পর্যন্ত ৬২ জন নিহত হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ধর্মের নামে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সন্দেহভাজনের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা শুরু হয়েছে গত বছর নভেম্বর থেকে। গত দু’মাসে এ ধরনের সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছে ১৯ জন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ, নীতিমালা, সংবিধান ও প্রচলিত আইন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সমর্থন করে না। যে যতবড় সন্দেহভাজন বা যতবড় অপরাধীই হোক না কেন তার আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার স্বীকৃত। সন্দেহভাজন বা অপরাধী ধরার পর প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ, তথ্য ও সাক্ষ্য-সাবুদ সংগ্রহ এবং অভিযোগ পত্র তৈরী তদন্তকারী বা আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাজ। বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অপরাধীর ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ধারিত হওয়ার কথা। এটাই নিয়ম ও বিধি। এর ব্যতিক্রম হলে অর্থাৎ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগেই যদি অপরাধীদের মৃত্যু ঘটে বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার ও হেফাজতে থাকা অবস্থায়Ñ তবে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের ব্যত্যয় সাধিত হয়। এতে যেমন ‘অনেক কিছুই’ অজানা থেকে যায়, তেমনি অপরাধী আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, অপরাধীর যথাযথ বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত ও সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত যারা সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারে তারা নিহত হয়েছে তাদের ব্যাপারে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, মানবাধিকার কর্মী ও জঙ্গিবিষয়ক বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, তারা জীবিত থাকলে তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারত এবং জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হতো। অর্থাৎ এই সুযোগ-সম্ভাবনা এর ফলে অনেকটাই রহিত হয়ে গেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, বলাই বাহুল্য মানুষের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি করছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর নামে গ্রেফতার, উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পরে খোঁজ না পাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মানুষ ভীতি ও আতংকের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ বিদ্যমান আইন যদি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা মান্য করে চলেন, তবে মানুষের ভীতি-আতংক কমে এবং তাদের প্রতি জনআস্থাও বৃদ্ধি পায়।
২০১৩ সালে প্রণীত নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি আইন-শৃংখলা বাহিনীর জন্য একটা বড় ধরনের সতর্কবার্তা। ওই আইনে ‘হেফাজতে’ মৃত্যু বলতে সরকারী কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গ্রেফতারের সময় কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, মামলার সাক্ষী হোক বা হোক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত। ‘নির্যাতন’ বলতে কষ্ট হয়, এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বুঝানো হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী হেফাজতে মৃত্যুর দায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর বর্তাবে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন মোতাবেক বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর দায় জড়িত কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে বহন করতে হবে। নিরাপত্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বা অন্য কোনো অজুহাত দেখিয়ে কেউ পার পাবে না। বর্তমানের মতো ভবিষ্যতেও এ আইনে এ ধরনের ঘটনার বিচার হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অন্যূন যাবজ্জীবন কারাদ- ও অর্থদ- হবে। এই আইনকে ‘ঘুমন্ত বাঘ’ হিসেবে মনে করেছে সংশ্লিষ্টরা। আইনটি যথেষ্ট প্রচারিত নয়। জনসাধারণ আইনটির ব্যাপারে তেমন অবহিত ও সচেতন নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরাও বেশী কিছু জানেন বলে মনে হয় না। তারা আইনটি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হলে, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অনেক কমে যেতো। তারা আরো মনে করেন, আইনটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়া দরকার। ইতোপূর্বে দেয়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও এই আইন মেনে যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কাজ করে তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কমার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি জনআস্থা বৃদ্ধি পাবে। সরকারের ভাবমর্যাদাও উজ্জ্বল হবে। খবরে জানা গেছে, পুলিশ প্রশাসন থেকে সরকারের কাছে আইনটির ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়েছে এবং সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনটির মধ্যে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত এক ধরনের রক্ষাকবচ আছে যা উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। আইন প্রয়োগকারীদের দায়মুক্তি নয়, দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা আশা করবো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সতর্কতা ও সাবধানতার সঙ্গে এবং আইনী বিধি-বিধান খেয়াল রেখে, মান্য করে দায়িত্ব পালনে যতœশীল হবে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন