সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনা নিয়েই জীবন সচল রাখতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনাভাইরাস মানুষের পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে নতুন নতুন মুখ সংযুক্ত হচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশ্ব এ অদৃশ্য ভাইরাসে পর্যুদস্ত। মানুষের জীবনে পথচলা শ্লথ হয়ে গেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করেছিল, করোনা বেশি দিন থাকবে না কিন্তু এ ধারণা এখন পাল্টেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা বলেছে, এ মহামারি সহজে যাচ্ছে না। কবে যে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মানুষ মুক্তি পাবে কেউ বলতে পারছে না। এ দিকে ভ্যাকসিন তৈরির কাজও চলছে, ভ্যাকসিন আসলেই যে করোনা চলে যাবে এমনাটও কেউ বলতে পারছে না। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এ ভাইরাস নিয়েই আরও অনেকদিন চলতে হবে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্ক পরে নিজেদেরকে নিরাপদে রেখে প্রতিটি মূহুর্ত অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকে না। প্রয়োজনের তাগিদেই জীবিকার সন্ধানে কর্মস্থলে বের হতে হচ্ছে। করোনা নিয়েই জীবন ও অর্থনীতি চালিয়ে যেতে হবে। করোনা মানুষের জীবনের অনেক পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। কোনটা মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন, কোনটা মানুষের কম প্রয়োজন, কোন জিনিস না হলেও চলা যায়, এটা বুঝতে কারো বাকী নেই। মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসস্থল ছাড়াতো মানুষ চলতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের জন্য শিল্প ও পণ্য উৎপাদনের কাজও চালাতে হবে। তাই জীবন ও অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য নতুন কৌশলে, নতুন আঙ্গিকে পরিকল্পনা নিয়ে চালিয়ে যেতে হবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ড। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে উন্নতির দিকে এগুচ্ছিল, করোনা এসে তা থমকে দিল। বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। করোনা কালে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়েছে বলে বলা হয়েছে। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন কোটির মতো। করোনাকালে এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কর্মসংস্থানের বৃহৎখাত পোশাক শিল্প থেকে ছাঁটাই শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এতে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রয়াত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার পাশাপাশি মৌসুমি অনেক শ্রমিক বেকার হবে। অনেক প্রবাসী ইতোমধ্যেই দেশে ফিরে এসেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে ১০ লাখ শ্রমিক ফিরছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ নতুন শ্রমিক নেয়া বন্ধ বা কমিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লোক ছাঁটাই কিংবা বেতন কমিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে। ফলে দরিদ্র অতি দরিদ্র, নিম্নবিত্ত দরিদ্র, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা অশনিসংকেত। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নেতিবাচকের দিকে ধাবিত হবে। উন্নয়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে এবং হচ্ছে।

মানুষ যতদিন ঘরে থাকবে বা কর্মে ফিরে না আসবে ততদিন অর্থনৈতিক অবস্থার স্থবিরতা কাটবে না। তাই উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড দ্রুত শুরুর বিকল্প নেই। করোনাকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনামূলক প্যাকেজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন বোনাস দেয়া সহ নানামুখী প্রণোদনা প্যাকেজ প্রশংসনীয় হলেও তা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। আর্থিক সহায়তা ও ত্রাণ দিয়ে অর্থনীতিকে বেশি দূর আগানো যাবে না। মানুষকে কাজে ফিরাতে হবে, কর্মসংস্থান করতে হবে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষ যখন জীবিকার তাগিদে কাজে বের হবে, তখনই অর্থনীতির চাকা সচল হবে। করোনার এ মহামারিতে তাই প্রথমে কৃষিতে মনোযাগী হওয়া উচিৎ।

করোনা মহামারি রোধে সৃষ্ট লকডাউনের কারণে কৃষি উৎপাদন সহ সকল উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানা বন্ধ থাকার কারণে দারিদ্র্য অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যাভাবে বিশ্বের সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন এখনও অনেক দেশের তুলনায় ভালো আছে। তবে ইতোমধ্যে প্রবল বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর চাষের জমি তলিয়ে গেছে, নানা ধরনের ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক ভাটা পড়বে। তাই করোনা ও বন্যার এ ভয়াবহতার মধ্যেও কৃষিকে ও কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে, কৃষিজ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের প্রধান সতর্ক করে বলেছেন, ক্ষুধার মহামারির দ্বার প্রান্তে অনেক দেশ দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত ৩৬টি দেশে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। মানুষের মৌলিক চাহিদা ও খাদ্যের লভ্যতা নিশ্চিতকরণই উন্নয়নের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। খাদ্যের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে না পারলে ভবিষ্যতে অপরিমেয় মানবিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না। তাই করোনার এই মহামারিতে কৃষিকে টেকসই করা, প্রয়োজনীয় কৃষি সরঞ্জামাদি, বীজ, সার, কীটনাশক ও প্রয়োজনীয় কৃষি শ্রমিক একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

করোনাকালে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত হলো স্বাস্থ্যখাত। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা টেকসই করার জন্য রোগ প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জবাবদিহিতার দারুণ অভাব রয়েছে তা দূর করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের কঠোর শাস্তি প্রদান করে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরাতে হবে। প্রতিটি হাসপাতাল, শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদির ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে মানুষের জীবিকার পথ মসৃণ করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের স্তম্ভ। এটি প্রতিটি দেশের নিরাপত্তা উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সাথে জড়িত।

অর্থনীতি কার্যক্রম সচল রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। অনলাইনে ব্যাংকিং, অনলাইনে কেনাকাটা, পণ্য আদান-প্রদান, শিক্ষা কার্যক্রম, বিনোদন, বিভিন্ন বিল পরিশোধে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারকে এর সহজলভ্যতা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধির জন্য আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতিধারাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিশেষ করে চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ ক্রমগতভাবে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে চীনের উপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্ভরশীলতা রয়েছে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের অংশ প্রায় ১৩ শতাংশ। দেশটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারকও। বৈশ্বিক আমদানির ১১ শতাংশ হয় চীনের মাধ্যমে। চীনের উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরতা অনেক। চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য-অংশীদার। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। তার কাঁচামালের জন্য চীনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। চামড়া জাত পণ্য ও ঔষধ উৎপাদনের জন্যও চীন থেকে বাংলাদেশ কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশে চলমান অধিকাংশ বৃহৎ প্রকল্প চীনা বিনিয়োগে চলছে। করোনার কারণে এগুলোর কার্যক্রম মন্থর হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির গতিকে দ্রুত করতে এসব দেশের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

করোনাভাইরাসের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবে বলে অর্থনীতিবিদরা যে আশংকা করেছিলেন তা অনেক দেশে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা বলেছে, করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ২০২১ সালের আগে মার্কেটে আসবে না। ফলে সংকট আরও দীর্ঘ হওয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে মন্দার সূচনা হয়েছিল সেই মন্দা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। তখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল। এবার করোনা কেন্দ্রিক মন্দা দূর করার জন্য শুধু ক্রয় ক্ষমতা বা ভোক্তার চাহিদা চাঙ্গা করার চেষ্টা করলে চলবে না। পাশাপাশি প্রয়োজন সাপ্লাই বা সরবারহ বাড়ানো, সাপ্লাই বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে, চাহিদাও সৃষ্টি হবে। পণ্যের হাত বদল বাড়বে। অর্থনীতি গতিশীল হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন