করোনার মহামারীসহ বিভিন্ন কারণে বিপর্যস্ত বিমান ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এজন্য নেয়া হচ্ছে বিশেষ ‘কর্মপরিকল্পনা’। আয়ের উৎস না বাড়িয়ে শুধু ‘কর্মপরিকল্পনা’র মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে জাতীয় পতাকাবাহী এই সংস্থাটি। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে উড়োজাহাজ রয়েছে ১৮টি। এসব উড়োজাহাজের জন্য কেবল রক্ষণাবেক্ষণেই বিমানকে প্রতি মাসে খরচ করতে হয় ২৬৬ কোটি টাকা। গত দু’বছরে বিমান বহরে ৬টি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ যোগ হলেও রুট বেড়েছে মাত্র তিনটি। চলতি বছর একাধিক নতুন রুটে যাত্রার উদ্যোগও পিছিয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের মহামারীতে। বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা না তোলায় বিদ্যমান ১৮টি রুটের মধ্যে বর্তমানে মাত্র চারটি রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। অথচ দেশে লাখ লাখ প্রবাসী আটকা পড়ে আছে। তারা ফ্লাইটের অভাবে বিদেশ যেতে পারছেন না। টিকিটের জন্য হাহাকার লেগেই আছে। বায়রার হিসাবে দেশে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ প্রবাসী কর্মী ফ্লাইটের অভাবে চাকরির ঝুঁকিকে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে। ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রীর স্বপ্নও ভেঙ্গে যেতে বসেছে। অথচ বিমান করোনার দোহাই দিয়ে ফ্লাইট বন্ধের মেয়াদের ঘোষণা দিয়ে দায় এড়িয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে বিশেষ ফ্লাইট ঠিকই চালানো হচ্ছে প্রবাসীদের দেশে ফেরাতে।
আটাবের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ (মাহবুব) করোনা মহামারিরর কারণে কয়েক লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মী ছুটিতে এসে আটকা পড়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিমানের বিশেষ ফ্লাইট চালুর জোর দাবি জানিয়েছেন। আটাবের সাবেক নেতা মাহবুব বলেন, জাতীয় স্বার্থেই বিমানকে অতিরিক্ত ¯øট নিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের পার করতে হবে। তিনি বলেন, সৃষ্ট দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে হলে বিমানকে সেবার মান বাড়াতে হবে। প্রতি জেলায় বিমানের বুথ স্থাপন করে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে হবে। বিমান বিদেশ গমনেচ্ছু যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোর মাধ্যমে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে বিশেষ ফ্লাইট চালুর ব্যবস্থা করতে পারে।
বিমান সূত্র জানায়, বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে থাকা ১৮টি উড়োজাহাজের মধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে সরাসরি কেনা হয়েছে ১২টি। এগুলোর মধ্যে ৪১৯ আসনের লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ রয়েছে চারটি। ২০১১ থেকে ২০১৪-এ তিন বছরের মধ্যে উড়োজাহাজগুলো বিমানবহরে যুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে যুক্ত হয় ১৬২ আসনের দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও ২৭১ আসনের ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’ উড়োজাহাজ। বিমানের বাকি ছয়টি উড়োজাহাজের মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও ৭৪ আসনের দুটি ড্যাশ-৮ লিজে আনা হয়েছে। বর্তমানে এসব উড়োজাহাজের জন্য কেবল রক্ষণাবেক্ষণেই বিমানকে প্রতি মাসে খরচ করতে হয় ২৬৬ কোটি টাকা। এই খরচ পোষাতে ফ্লাইট বাড়ানোর জরুরি হলেও রহস্যজনক কারণে তা হচ্ছে না। এতে করে বিমান মূলত উল্টোপথেই হাঁটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, একটি এয়ারলাইনসে যত বেশি উড়োজাহাজ থাকবে, তত বেশি বাণিজ্যিক সুবিধা মিলবে। বহর শক্তিশালী হলে বিমানের সেবা ও বাণিজ্য বাড়বে- এটা এতদিনেও বোঝার চেষ্টা করেনি বিমান। বর্তমানে ছোট আকারের উড়োজাহাজের অভাবে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছে না। করোনার মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিমানের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় নি। বরং যাত্রীদের দাবির মুখে বার বার নানা অজুহাতে পাশ কেটে চলার চেষ্টা করছে বিমান। এ প্রসঙ্গে বায়রার যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান বলেন, করোনা মহামারির কারণে ছুটিতে এসে কয়েক লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে আটকা পড়েছেন। এদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় স্বার্থে আটকে পড়া এসব প্রবাসী কর্মীদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে পৌঁছে দিতে ওপেন স্কাই ঘোষণা করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, জনশক্তি রফতানির এই খাত না বাঁচলে দেশের অর্থনীতি বাঁচবে না। দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতেই কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
জানা গেছে, বিমানে গত বিশ বছর ধরে নেই কোনো বড় ধরনের অফিসার নিয়োগ। এখন যারা বিমানের শীর্ষ স্তরে কর্মরত, তাদের শতকরা ৮০ ভাগই পদোন্নতিপ্রাপ্ত। বছর তিনেক আগে কজন অফিসার নিয়োগ দিতে গিয়েও হোঁচট খায় সিবিএর কারণে। ফলে দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে বিমানে। পিছিয়ে পড়ার এটাও একটা কারণ।
এদিকে, ঘুরে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুট বাড়ানোরও পরিকল্পনা নিয়েছে বিমান। আর দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও ৩টি ড্যাশ-৮ বিমান আনা হচ্ছে। একইসঙ্গে থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পেতে দক্ষ জনবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং নতুন আরও একটি হ্যাঙ্গার নির্মাণ হবে। আর বিমানে শুদ্ধি অভিযান চালানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নানা অপকর্মে জড়িত তাদের তালিকা করা হয়েছে। এজন্য সরকারের কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় চলতি অর্থবছরের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বিমান একটি শক্তিশালী এয়ারলাইনসে পরিণত হবে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনটি ড্যাশ ৮ চলতি বছরেরর মার্চ, মে ও জুনে সরবরাহ করার কথা ছিল কানাডার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বম্বার্ডিয়ার ইনকরপোরেশনের। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে সময়মতো বিমানগুলো সরবরাহ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিমানের জন্য ৩টি উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ ও কানাডা সরকারের মধ্যে জিটুজি পদ্ধতিতে সরাসরি ক্রয় চুক্তি হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহিবুল হক বলেছেন, বিমান নতুন ব্যবস্থাপনায় যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল, হঠাৎ করোনা তান্ডবে ততটাই নিম্নমুখী হয়ে এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা। বিমান এই পরিকল্পনায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন