ডায়াবেটিস শুধুমাত্র শারীরিক রোগ নয়, এটি মনকেও গভীরভাবে আক্রান্ত করে। শুরুতেই যখন কাউকে জানানো হয় যে আপনার ডায়াবেটিস হয়েছে যা আজীবনই থাকবে এবং আপনাকে জীবন যাপন পরিবর্তন করাসহ ক্রমশ বেশী সংখ্যক ওষুধ সেবন করার দরকার হতে পারে; এ তথ্যগুলোই ডায়াবেটিসের রোগীকে মানসিক চাপে বা মানসিক অবসাদে ফেলতে পারে।
করোনা ভাইরাসঘটিত মহামারী, কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক সারা বিশ্বকে গ্রাস করেছে। অন্য বেশ ক’টি রোগে আক্রান্তদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। আর যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে মৃত্যু হার অন্তত ৪ গুণ বেড়ে যায়। যাদের আগে থেকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল না তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশী। এসব নির্মম তথ্যগুলো ডায়াবেটিস রোগীর মানসিক চাপ বৃদ্ধির অমোঘ কারণ হিসেবে কাজ করছে।
এ সব ব্যাপার মনে রেখে, ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা সেবা বিন্যস্ত করতে হবে।
রোগটি যেহেতু ডায়াবেটিস, তাই রক্তের গ্লুকোজ কাঙ্খিত মাত্রায় রাখাটাই সবচেয়ে জরুরী কাজ। যাদের রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্যমাত্রায় ছিল, তারা ভালো অবস্থায় আছে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় ৭৫% রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকেনা; সে সব রোগীর রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্যে হরমোন/ ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
করোনা ভাইরাস (কোভডি ১৯) মহামারিতে ডায়াবেটিস রোগীর আশু করনীয়ঃ
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সামান্যতম লক্ষণ দেখা দিলেই সরকার নির্দেশিত কেন্দ্রগুলোতে রোগ শনাক্তকরণ ও পরবর্তী সেবার জন্যে দ্রুত চলে যাওয়া।
কালক্ষেপেন না করে অতি সত্তর রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য মাত্রায় নিয়ে (এইচবিএওয়ানসি <৭%) যাবার উদ্যোগ নেয়া।
যদি লক্ষণ দেখা দেয় (জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট)- তাহলে নিজেকে নিজে আলাদা করে রাখাই শ্রেয়। শরীর বেশী খারাপ না হলে হাসপাতালে না যাওয়াই ভাল। ৮০% মানুষ কোন হাসপাতালে ভর্তি ছাড়াই ভাল হয়ে যায়। অসুস্থতার প্রথম ১৪ দিন নিজেকে আইসোলটে করে রাখবেন।
বয়স্ক লোকজন এর মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী। বয়স্ক কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করার কারন আছে। কারণ তাদের অনেকেরই আইসিইউ সার্পোট লাগতে পারে।
এবারের সব চেয়ে সমস্যা হল লক্ষণহীন রোগীরা। যেমন জার্মানিতে অনেকে আছে যাদের পাওয়া গেছে কোন কাশি নেই, কোন জ্বর নেই, কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায় তাদের করোনা ভাইরাসের সংক্রমন হয়েছে। ইতালিতেও এমন অনেককে পাওয়া গিয়েছে, এমনকি যুক্তরাজ্যেও। এ নিয়ে সবচেয়ে বড় ভয় এটাই যে একদম লক্ষন ছাড়া অনেক মানুষজন করোনা ভাইরাস নিয়েই ঘুরাফেরা করছে। এখন বলা যাচ্ছেনা তাদের মাধ্যমে অন্যদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা কতটুকু।
স্যানিটাইজার ভাল হলেও, মার্কেটের অধিকাংশ স্যানিটাইজারে পর্যাপ্ত পরিমান এলকোহল নাই (যেটা পান করে ওই এলকোহল না)। সাবান দিয়ে হাত ধোন, বেশী বেশী ধোন। অতিরিক্ত করতে চাইলে বরং হেক্সিসল টাইপের কিছু ব্যবহার করুন। ঘরের বাইরে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলেও মুখে হাত দিবেন না যতক্ষন না কোথাও গিয়ে হাত ধুতে পারবেন।
বড় সমাবেশ/ লোক সমাগম থেকে দুরে থাকাই ভাল। কোন কনফারন্সে বা পার্টিতে যাবেন না।
ভাবাবেগের অনেক কিছুই আপনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
চারপাশের অনেক কিছুই আগের মত নেই ভেবে মনঃকষ্ট পাবেন না। পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করুন। ডায়াবেটিস আছে বলে নিজেকে অতি দুর্বল অবস্থায় আছেন না ভেবে বরং হরমোন/ ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক চলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসুন এবং তা বজায় রাখুন। সঠিক খদ্যাভ্যাস ও ঘর-ছাদ-বারান্দা-গ্যারেজে হাঁটুন। এগুলো শরীর ও মন দু’টুকেই সতেজ-চাঙ্গা রাখবে। নিজের প্রতি দয়াশীল হোন, যত্নশীল হোন।
যদি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েই যান, নিজেকে নিঃসঙ্গ না ভেবে পরিবার ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ এবং এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাহায্য নিন। আশে পাশের অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ভালো হয়ে গিয়েছেন, মনে রাখবেন সেটা।
ডায়াবেটিসের রোগী কোভিড-১৯-এ আক্রান্তহলে রক্তের গ্লুকোজ চটজলদি বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই, এ সময় ঘন ঘন গ্লুকোজ মেপে ওষুধ সমন্বয় করার দরকার হবে। অনেকের ক্ষেত্রে নূতন করে ইনসুলিন শুরু করতে হতে পারে। আবার কারো কারো রক্তের গ্লুকোজ কমেও যেতে পারে। সকল ক্ষেত্রেই ঘন ঘন গ্লুকোজ মেপে ওষুধ ঠিক নিতে হবে।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক,
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: selimshahjada@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন