গত ১৩ আগস্ট ২০২০ ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপরই এর বিরুদ্ধে মুসলিম জাহানব্যাপী যে নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো থামেনি। ইতোমধ্যে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে হয়েছে ইউ.এ.ই দূতাবাসে হামলা। এ উদ্যোগকে বিশ্বাসঘাতকতা ও পিঠে ছুরি মারার শামিল মনে করছেন ফিলিস্তিনি নেতারা। তারা একে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আমিরাত থেকে অবিলম্বে তাঁদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এক ঘোষণায় জানিয়েছেন, তুরস্ক আমিরাতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। ইতিহাস আরব আমিরাতকে কখনও ক্ষমা করবে না, এ চুক্তি মুসলিম বিশ্বকে আরো রক্তাক্ত করবে। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, এ চুক্তি মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করবে এবং লড়াইয়ের মুখোমুখি করবে। ইরান সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নির্যাতিত ফিলিস্তিনী জাতিসহ বিশ্বের কোন স্বাধীনচেতা জাতি ‘অবৈধ দখলদার ও অপরাধী ইসরাইলের’ সঙ্গে তার অপরাধের ভাগীদারদের এ সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়াকে কখনো ক্ষমা করবে না। ১৮ আগস্ট তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে হয়েছে বিক্ষোভ সমাবেশ। তাদের অনেকের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল ‘বায়তুল মোকাদ্দাসকে বিক্রি করে দিয়েছেন আবুধাবির যুবরাজ।’ এভাবে ক্ষোভ, ধিক্কার, নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে অন্যত্রও।
স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীনই ওদের সাথে বন্ধুত্ব না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন মুমিনদেরকে। বলেছেন: ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের কেউ তাদেরকে বন্ধুৃ রূপে গ্রহণ করলে সেও হবে তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে সংপথে পরিচালিত করেন না।’ (৫:৮২)
আল্লাহ পাক আরো বলেন : ‘ইয়াহুদি এবং খ্রিস্টানগণ তোমাদের প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করবে। বল, আল্লাহর পথ নির্দেশই প্রকৃত পথনির্দেশ। জ্ঞান লাভের পর তুমি যদি তাদের অনুসরণ কর (সেটা হবে আল্লাহর বিপক্ষে যাওয়া, আর) আল্লাহর বিপক্ষে (গেলে) তোমার কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।’ (২:১২০)
অন্যত্র পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: ‘অবশ্য মুমিনদের প্রতি শত্রু তায় মানুষদের মধ্যে ইয়াহুদি ও মুশরিকদেরকেই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে।’ (৫:৮২)
ইহুদিদের অর্থগ্রধ্নতা, লোভ-লালসা, নির্মমতা-নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতি-দুষ্কৃতির বহু বিবরণী বিধৃত রয়েছে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে ও ইতিহাসের পাতায়। তারই যৎসামান্য তুলে ধরার প্রয়াস পাব এ স্বল্প পরিসর নিবন্ধে।
অবশ্য, অনেক নবী-রাসুলের আবির্ভাব ঘটেছে বনি ইসরাইল কওমে। আমরা তাদের উপর ঈমান পোষণ করি। অনেক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক জন্মেছেন যেমন তাদের মধ্যে, তেমনি জন্মেছে সামেরী, কারূনসহ এমন অনেক কাফের বেঈমান, নিষ্ঠুর জালেম, পাপাচারী, যাদের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। তারা অনেক নবী-রাসুলকে করেছে হত্যা, অনেক জনপদকে করেছে ধ্বংস, পুড়িয়ে মেরেছে অনেক ঈমানদার নারী-পুরুষকে। এখনও অব্যাহত রয়েছে তাদের মানবতাবিরোধী এ অপতৎপরতা, নির্মম নিষ্ঠুরতা, জুলুম ও নির্যাতন। বিশ্ববাসী প্রতিনিয়ত দেখছে তা ফিলিস্তিনে- আরব ভূখন্ডে।
অতীতে হত্যা করেছে তারা নবী হযরত জাকারিয়া (আ.) কে, হযরত ইয়াহইয়া (আ.) কে, তাদের দাবি মতে, হযরত ঈসা (আ.) কে এবং আরও অনেক নবীকে। (পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, তারা হযরত ঈসা (আ.) কে হত্যা করতে পারেনি আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন।) আমাদের পেয়ারা নবী, আল্লাহর হাবীব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে বারবার। বারবার তারা ষড়যন্ত্র করেছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সন্ধি ও চুক্তি ভঙ্গ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এমনকি সম্প্রতি আরব আমিরাতের সাথে চুক্তিকালে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন: ‘পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনী ভূমি দখলের যে পরিকল্পনা তিনি নিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে সাময়িকভাবে অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তা রক্ষা করা হয়েছে। তবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করণের বিষয়টি তিনি এখনো বাতিল করেননি। তা এখনো বিবেচনায় রয়েছে।’ তবু আমিরাত চুক্তিবদ্ধ হলো। কার্ল মার্কস বলেছিলেন: ‘এসব ভদ্রলোকের কারবার জনসাধারণ নিয়ে নয়, তাদের সামাজিক অবস্থা নিয়ে নয়, প্রতিষ্ঠান নিয়ে নয়, শুধু রাজদরবার, রাজপ্রাসাদ নিয়ে।’ এ চুক্তি যেন তারই এক রূপ।
ইয়াহুদিদের দুষ্কৃতির ইতিহাস সুদীর্ঘ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হুকুমে হযরত মূসা (আ.) সিরিয়া ও বায়তুল মোকাদ্দাস জয়ের জন্য অভিযান চালালেন। এলাকার নিকটবর্তী হয়ে তিনি সেখানকার খবর সংগ্রহের জন্য লোক পাঠালেন। সেখানে বসবাস করত ‘আমালেকাগণ’। তারা ছিল বিস্ময়কর শৌর্য বীর্যের অধিকারী দুধর্ষ এক সম্প্রদায়। প্রেরিত লোকেরা যখন ফিরে এসে তাদের অবস্থা জানাল তখন ইয়াহুদিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। ‘তারা বলল: হে মুসা, আমরা জীবনেও কখনো সেখানে যাব না, যতক্ষণ তারা সেখানে থাকবে। সুতরাং আপনি আর আপনার খোদাই সেখানে যান এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানে বসে থাকব। মুসা বললেন, হে আমার পরোয়ারদেগার! আমি ও আমার ভাই ব্যতীত অপর কারও উপর আমার আধিপত্য নেই। সুতরাং আপনি আমাদের ও সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়সালা করে দিন। আল্লাহ বললেন: এ দেশ চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য হারাম করা হলো। তারা পৃথিবীতে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। অতএব, তুমি সত্য প্রত্যাখ্যানকারী সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো না।’ (৫: ২৪, ২৫, ২৬)
ইসরাইলিদের দুষ্কৃতির আরেক ঘটনা হলো, গো বৎস পূজা। হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর হুকুমে তূর পাহাড়ে গেলেন তাওরাত কিতাব আনতে। এ দিকে সামেরী নামের এক নরাধম স্বর্ণ দিয়ে একটি গোবৎস তৈরি করল, সেটি শব্দ করতে পারত। সে বনি ইসরাইলদের বলল, মুসা (আ.) আর ফিরে আসবে না। এসো, আমরা এই গোবৎসটির পূজা করি। হযরত হারূন (আ.) ও কয়েকজন খাঁটি মুমিন ছাড়া অন্য সকলে গোবৎস পূজা ও আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল। মুসা (আ.) তূর পাহাড় থেকে তাওরাত নিয়ে ফিরে এসে এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, ‘সামেরী’ই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। তিনি তিরষ্কার করে বললেন, দূর হও! তুমি সারাটি জীবন অপদস্ত হতে থাকবে আর বলতে থাকবে আমি অস্পৃশ্য। আর পরকালে জাহান্নামের শাস্তিতো তোমার জন্য নির্ধারিত রয়েছেই। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন, অভিশপ্ত ও অস্পৃশ্য অবস্থা বহাল রইল তার মৃত্যু পর্যন্ত। আর হযরত মুসা (আ.) গোবৎস পূজারীদেরকে আল্লাহর হুকুম জানিয়ে দিলেন: ‘গোবৎসকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে তোমরা নিজেদের প্রতি ঘোর অত্যাচার করেছ। অতএব, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর এবং নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা কর।’ (২: ৫৪)
ইয়াহুদি পাপিষ্ট কারুন আল্লাহর রাসূল হযরত মুসা (আ.) এর বিরুদ্ধে জঘন্যতম মিথ্যা অপবাদ রটাতে গিয়ে স্বীয় অঢেল সম্পদসহ মৃত্তিকা-তলে প্রোথিত হয়ে ধ্বংস, নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
আল্লাহর নবী জাকারিয়া (আ.) বনি ইসরাইলদের হেদায়েতের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল এবং প্রাণনাশে বদ্ধপরিকর হলো। তিনি মুজিযা বলে গাছের মধ্যে আত্মগোপন করলেন। ঘাতকরা তা আবিষ্কার করতে পেরে করাত দিয়ে গাছসহ তাঁকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলল। জাকারিয়া (আ.) এর শাহাদতের পর তাঁর পুত্র হযরত ইয়াহইয়া (আ.) নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন। তিনি দিন রাত মসজিদে আকসায় ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন আর বনি ইসরাইলদের হেদায়েতের বাণী শুনাতেন। দুষ্ট ইসরাইলীরা তাঁকেও শহিদ করে দেয়। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ.) শনিবার দিন দরিয়ার তীরে বসে সুমধুর কণ্ঠে যবুর কিতাব তিলাওয়াত করতেন। শনিবার হলো ইহুদিদের সাপ্তাহিক ইবাদত ও ছুটির দিন। দরিয়ার মাছেরাও তীরে এসে তন্ময় হয়ে শুনত সেই সুমিষ্ট তিলাওয়াত। ঐ দিনটিতে আল্লাহপাক নিষিদ্ধ করে দিলেন মাছ শিকার করা। একদল দুর্মতি ইয়াহুদি মাছ শিকারের এক ফন্দি আঁটল। তারা দরিয়া-তীরে পুকুর খনন করে খাল কেটে সংযোগ ঘটাল ঐ সব পুকুরের সাথে। অনেক মাছ ঐ পথে পুকুরে প্রবেশ করে শুনত হযরত দাউদ (আ.) এর তিলাওয়াত। মাছ ঢুকার পরে তারা বন্ধ করে দিত পুকুরের সাথে খালের সংযোগ মুখ। ঐসব ইয়াহুদি শনিবারে শিকার না করে আটকে রাখা মাছ পরে শিকার করত। চলল এভাবে অনেকদিন। তাদের এই বাদরামীতে আল্লাহ ক্রুদ্ধ হলেন, গজব নাযিল করলেন। হুকুম দিলেন ‘তোরা ঘৃণিত বানর হয়ে যা’। (৭: ১৬৬) তারা বানর হয়ে গেল এবং ২/৩ দিনের মধ্যে সব মারা গেল।
বনি ইসরাইলিরা বিভিন্ন সময় লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন: ‘তারা আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হয়েছে এবং হীনতাগ্রস্থ হয়েছে এ জন্য যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করত এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করত।’ (৩: ১১২)
তারা ইসরাইল বংশীয় বহু নবী কে তো হত্যা করেছেই, এমন কি আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে। এখানে তার দু’একটি ঘটনা পেশ করছি।
ইয়াহুদিরা তওরাত, যবুরের মাধ্যমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিচয় ভালভাবেই জেনে ছিল। তাদের অভিজ্ঞ জ্যোতিষিরা গ্রহ-তারকার অবস্থান বিচার করে তাঁর আবির্ভাব সম্পর্কেও জ্ঞান রাখত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন: ‘যাদেরকে আমি কিতাব (তওরাত, ইঞ্জিল) দিয়েছি (তার ভিত্তিতে তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)কে) এমন সন্দেহাতীতভাবে চেনে, যেমন নিজেদের সন্তান-সন্তুতিকে চিনতে পারে।’ (২: ৪৬) অর্থাৎ, নিজেদের সন্তান-সন্তুতিকে যেমন কখনো সন্দেহ হয় না যে, সে কে, সেভাবে মুহাম্মদ (সা.) এর রাসূল হওয়া সম্পর্কেও তাদের মনে কোন সন্দেহ সংশয় নেই। এতদসত্তে¡ও নবুওয়াতের মহানিয়ামত ইসরাইলিদের নিকট থেকে ইসমাঈলীয়দের কাছে চলে যাবে এটা ছিল তাদের নিকট অসহনীয় ও ঈর্ষার কারণ।
হযরত (সা.) এর বয়স যখন ১২, তখন চাচা আবু তালেবের সাথে বানিজ্য উপলক্ষে তিনি সিরিয়ায় যান। তাদের কাফেলা ‘বুসরা’ নামক স্থানে এসে (স্থানটি, বর্তমান জর্দান-সিরিয়া সীমান্তে) এক বৃক্ষ-তলে তাবু ফেলে। (বৃক্ষটি এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে এবং বহু পুন্যার্থি তা জিয়ারতে যান।) নিকটেই ছিল এক খ্রিস্টান মঠ। সেখানে ‘বহিরা’ নামক এক নেস্টরীয় খ্রিস্টান সন্যাসী বাস করতেন। তিনি কোরেশদের তাবু এবং বৃক্ষতলে কিশোর মুহাম্মদ (সা.) কে দেখতে পেলেন। দেখলেন, বৃক্ষের ডালপালা তাঁর দিকে ঝুকে পড়ে ছায়া দান করছে। শেষ নবীর অবয়ব ও তার আগমন কাল যে আসন্ন, তা তিনি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের মাধ্যমে জেনে ছিলেন। তিনি কাফেলার লোকদের মঠে দাওয়াত করে আপ্যায়ন করলেন, নবীজীকেও ডেকে আনালেন। তাঁকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দেখলেন এবং তিনি যে আখেরী নবী সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়ে চাচা আবু তালেবকে বললেন, এই কিশোরই প্রতিশ্রুত শেষ নবী। আপনি একে নিয়ে আর সিরিয়া সফর করবেন না। একে মক্কায় নিয়ে যান। ইয়াহুদিরা এর চরম শত্রু । তারা একে চিনতে পারবে এবং মেরে ফেলবে। আবু তালেব দ্রুত মালামাল ক্রয়-বিক্রয় করে বাণিজ্য যাত্রা শেষ করলেন।
প্রিয়নবী (সা.) হিজরত করে যখন মদীনায় এলেন, রাষ্ট্রশক্তি রূপে ইসলামের অভিযাত্রা শুরু হলো। তিনি বিভিন্ন গোত্রকে নিয়ে সনদ প্রদান করলেন। এটাই মদীনা সনদ নামে খ্যাত এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে এটাই দুনিয়ার প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। মদীনায় বসবাসরত ইয়াহুদি গোত্রসমূহের সাথে যে চুক্তি হলো তার প্রধান প্রধান ধারা হচ্ছে: ‘মদীনার ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক সকলেই এক দেশবাসী। সকলেরই নাগরিক অধিকার সমান। সকলেই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। কেউই কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাইরের কোনো শত্রু র সাথে কোনো সম্প্রদায় গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তার সমুচিত শাস্তি বিধান করা হবে।’
ইতিহাস সাক্ষী, মদীনার কোনো ইয়াহুদি গোত্রই এই চুক্তি রক্ষা করেনি। তারা তলে তলে নবীজী তথা মুসলমানদের প্রধানশত্রু মক্কার কাফেরদের সঙ্গে আঁতাত করেছে। তাদের কাছে রাষ্ট্রের গোপন সংবাদ পাচার করেছে। তাদের সাথে যুদ্ধকালে মুসলমানদের সাথে অংশগ্রহণ করেনি, বরং শত্রুদের সহযোগিতা করেছে। এমনকি নবীজীকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছে।
‘বনু কাইনুকা’ নামের প্রতাপশালী ইয়াহুদি গোত্র সর্ব প্রথম চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিম মহিলাদের অপমানিত করাসহ নানা উৎপাত শুরু করে এবং রণ হুংকার দিতে থাকে। বাধ্য হয়ে নবীজী (সা.) তাদের মহল্লা অবরোধ করেন ও অবশেষে মদীনা থেকে বহিষ্কার করেন।
এরপর বনু নাজির নামের ইয়াহুদি গোত্রও বিশ্বাসঘাতকতা করল। চুক্তি ভঙ্গ করল। মুসলমানদের সর্বনাশ সাধনের তৎপরতা চালিয়ে যেতে লাগল। এসব অপরাধে তারাও মদীনা থেকে বহিষ্কৃত হলো।
বনু কোরায়জা নামের ইয়াহুদি গোত্রও বিশ্বাস ঘাতকতা করে এবং নবীজীকে হত্যার উদ্যোগ নিয়ে চরম পরিণতি ভোগ করল।
খায়বার বিজয়ের পর সেখানকার জয়নাব নাম্নি এক ইয়াহুদি নারী প্রিয় নবীকে হত্যা করার জন্য গোশতভূনা করে তাতে তীব্র বিষ মিশ্রিত করে নবীজীকে হাদিয়া পাঠাল। নবীজী তা মুখে দিলেন, চিবিয়ে গলধকরণের আগেই বুঝতে পারলেন যে এতে বিষ মিশানো হয়েছে। তিনি সঙ্গীদেরকে তা খেতে নিষেধ করলেন। কিন্তু বশর নামের এক সাহাবী আগেই কিছুটা গোশ্ত খেয়ে ফেলে ছিলেন। বিষক্রিয়ায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। বশর হত্যার অপরাধে জয়নাবকে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করা হলো।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন