শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইয়াহুদি গোষ্ঠীর দুষ্কৃতি এবং বিশ্বাসঘাতকতা

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)


ইয়াহুদিদের এই বিশ্বাসঘাতকতা, দুষ্কৃতি চলে আসছে তাদের উদ্ভব কাল থেকেই। চলছে এখনো। আর কতদিন চলবে তা আল্লাই ভালো জানেন। কিয়ামতের আগে ঈমান লুটার জন্য যে দাজ্জাল বের হবে, দলিল প্রমাণ মেলে সেই দাজ্জালেরও জন্ম হবে ইয়াহুদি জাতিতে। প্রায় চার হাজার বছরের ইতিহাস বর্ণনা সম্ভব নয় স্বল্প পরিসর এ নিবন্ধে। তাই হালের আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের প্রয়োজনে আসছি, জেরুজালেম, মসজিদুল আকসা, ফিলিস্তিন ও ইসরাঈল প্রসঙ্গে।

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা ও মিরাজ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন: ‘পবিত্র ও মহিমাময় সেই স্বত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য, তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ মসজিদুল আকসা (আল কুদস, বাইতুল মাকদিস) প্রতিষ্ঠা করেন আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান। ৬৩৪-৬৩৫ সালে জেরুজালেম ও মসজিদুল আকসা বিজয় করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদকে করে তোলেন অধিকতর সুশোভিত। নির্মাণ করেন সুদৃশ্য গোল্ডেন টাওয়ার- স্বর্ণ গম্বুজ। ১১৩৮ সালে প্রখ্যাত তুর্কি সুলতান সোলাইমান নির্মাণ করে দেন সুবিখ্যাত জেরুজালেম দেয়াল। এর পর শুরু হয় সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী ক্রসেড যুদ্ধ। তারা দখল করে নেয় সিরিয়া, জেরুজালেম, মসজিদুল আকসা। ১১৮৭ সালে মহাবীর গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.) তাদের পরাজিত করে পুনরুদ্ধার করেন বাইতুল মাকদিস। এরপরে ১৭২০ সালে ইংরেজরা এই মসজিদসহ পুরো সিরিয়া এলাকা দখল করে নেয়। গাজী সালাহউদ্দীন ঘোষণা করেছিলেন খ্রিস্টানদের আর এ ভূমিতে ফিরে আসতে দেয়া হবে না। বৃটিশ সমরনায়ক দামেস্ক দখল করে গাজী সালাহউদ্দীনের কবর পার্শ্বে এসে কবরে লাথি মেরে দম্ভভরে হুংকার দিয়ে বলল, দ্যাখো সালাহউদ্দীন! আমরা আবার ফিরে এসেছি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরেও, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বৃটিশদের দখলেই ছিল জেরুজালেম ও বাইতুল মাকদিস।

বৃটিশদের প্রণীত বেলফোর ঘোষণা-বলেই স্বতন্ত্র ইয়াহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে বৃটিশ সৈন্য ফিলিস্তিন থেকে চলে যায়। এর সাথে সাথে ইসরাইল ঘোষণা করে স্বাধীনতা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এবং সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট স্টালিন সাথে সাথে স্বীকৃতি দেয় ইসরাইল রাষ্ট্রকে।

ইসরাইল মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পাহারাদার, ফিলিস্তিনের এক অংশের জবর দখলদার একটি জায়নবাদী অবৈধ রাষ্ট্র। জায়নবাদীদের লক্ষ্য ছিল একটি বৃহত্তর ইয়াহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ্য ছিল এ এলাকায় এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়া যে রাষ্ট্রটি হবে তাদের স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী- বরকন্দাজ। যেহেতু ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে এই এলাকার গুরুত্ব অপরিসীম। মানচিত্রের দিকে তাকালেই তা সহজেই বুঝা যায়। তিনটি মহাদেশের মিলন মোহনা হলো এ এলাকা। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক। উত্তর তীরবর্তী এলাকায় গ্রিসসহ ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ। দক্ষিণ পূর্ব কর্নারের পশ্চিম দিকে গাজা উপত্যকা, ফিলিস্তিন, মিসর। আর গোটা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে রয়েছে আফ্রিকান-আরব মুসলিম দেশসমূহ। অপরদিকে লোহিত সাগর আর ভূমধ্যসাগরের সংযোগ সৃষ্টিকারী সুয়েজ ক্যানেল- যার মত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ গোটা দুনিয়ায় আর নেই, রয়েছে এ এলাকাতেই। অনেক বন্দর রয়েছে এখানে, যেখানে যুদ্ধজাহাজ ভীড়তে পারে সহজেই। মধ্যপ্রাচ্যের লিকুইড গোল্ড প্যাট্রোল নিয়ে জাহাজগুলো পাড়ি জমাতে পারে বৃটেন, ফ্রান্স, আমেরিকায়; বাণিজ্য চলতে পারে ইচ্ছামত, অবাধে, অনায়াসে। এমনই গুরুত্ববহ ভূখন্ড ফিলিস্তিন, ইসরাইল।

কথায় বলে ‘কুকুর নেজ নাড়ায় কিন্তু এখন তো, নেজই কুকুর নাড়াচ্ছে’। ইয়াহুদি ধনকুবেরদের কবজায় আমেরিকার প্রধান প্রধান অস্ত্রখানা, শিল্প, বাণিজ্য ও রাজনীতির মূল চাবিকাঠি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। জনমত স্বপক্ষে আনতে হবে ট্রাম্পের। খুশি করত হবে জায়নলবীকে, তাই চমকতো একটা সৃষ্টি করতেই হবে এ সময়ই। আমিরাত-ইসারাইলের চুক্তিকালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বক্তব্যেও এর প্রমাণ মেলে। ‘পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের যে পরিকল্পনা তিনি নিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে সাময়িকভাবে অপেক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। চুক্তিতে তার সেই অনুরোধ মেনে নেয়া হয়েছে, তবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ ইসরাইলের অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি তিনি বাতিল করেন নি’।

ক্যাম্পডেভিট চুক্তি হয়েছে, আরও চুক্তি হয়েছে, এভাবে চুক্তি যাই হোক না কেন, শর্ত যাই থাকুক না কেন, ইয়াহুদিরা তার কোনো তোয়াক্কা করে না, কোনো কিছুর ধার ধারে না। সেই মদীনা সনদের সময় থেকে এটা চলে আসছে। এটা আরও তীব্র হয়েছে জায়নবাদী আন্দোলনের শুরু থেকে।

১৮৮২ সালে ‘হোভভেই জিয়ন’- ‘জিয়নের জন্য ভালবাসা’ (জিয়ন হলো জেরুজালেমের এক পাহাড়ের নাম) এই নামে রাশিয়ায় বসবাসরত কতিপয় উগ্রবাদী ইয়াহুদি সূচনা করে যে আন্দোলনের তারই নাম জায়নবাদ। পরে গঠন করা হয় এক বিশাল ফান্ড। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ইয়াহুদিরা এই ফান্ড থেকে অর্থ নিয়ে ফিলিস্তিনে গিয়ে জমি কিনে সেখানে বসবাস শুরু করে। মুসলিম প্রধান ফিলিস্তিনে ক্রমে বাড়তে থাকে ইয়াহুদিদের সংখ্যা। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ইয়াহুদিরা একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে মুসলিম জনপদে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর ওরা ১৫টি মসজিদকে সিনেগগে রূপান্তরিত করেছে, ৪০টি মসজিদকে ধ্বংস বা পরিত্যাক্ত করেছে, ১৭টি মসজিদকে গোডাউন, বার, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে বানিয়ে ব্যবহার করছে। তাদের দখলকৃত এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে মুসলমানদের। রক্ষণশীল ঐতিহাসিক টয়নবী লিখেছেন, ‘প্যালেস্টাইন থেকে আরব বিতাড়নের মতো অন্যায়ের কোনো তুলনা নেই ইতিহাসে।’ ‘জার্মানিতে নাৎসিরা যে অত্যাচার করেছিল তাদের উপরে, ফিলিস্তিনে তারা তাই করছে আরবদের উপরে।’ ওরা আক্রমণ চালিয়েছে মিশরের উপরে, সুয়েজ ক্যানেলে, জার্দানে, লেবাননে, সিরিয়ার উপরে। আক্রমণ করে ওরা দখল করে নিয়েছিল মিসরের এলাকা, দখল করে নিয়েছে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের জর্দান-ভূমি, সিরিয়ার গোলান হাইট এলাকা ও ফিলিস্তিনের অধিকাংশ এলাকা। ফিলিস্তিনি আরবদের বসতভিটা, বাড়িঘর জবর দখল করে তাদেরকে বানিয়েছে উদ্বাস্ত। ইসরাইলি এয়ারফোর্স সিরিয়ার নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে। অনুরূপ আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে ইরাকের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। ওরা ইন্ধন জোগাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দল-উপদলের মাঝে সংঘাত সৃষ্টির। এক দেশকে আর এক দেশের বিরূদ্ধে লাগিয়ে দেয়ার। আরবরা রাজায়-রাজায়, রাজায়-প্রজায়, প্রজায়-প্রজায়, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে যত লড়বে ততই বাড়বে ওদের প্রাধান্য। তাদের অনৈক্যই ডেকে আনবে ওদের সর্বনাশ। তারা যত দুর্বল হবে, তত বাড়বে ওদের ক্ষমতা ও দাপট। ইয়াহুদি-নাছারাদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে হলে চাই স্বাধীন, সার্বভৌম, শক্তিশালী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ার জন্য মুসলিম জাহানের সকল রাজা-বাদশার, সকল সরকারের সমবেত প্রচেষ্টা। নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া-ফাসাদ মিটিয়ে ফেলে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তারপরই কেবল সম্ভব ওদের কবজা থেকে সকল অধিকৃত ভূমি ফিরিয়ে আনা। পবিত্র কিবলাহ- কাবা শরীফ যেমন ইসলামী উম্মার জন্য উন্মুক্ত, এ উম্মাহর প্রথম কিবলাহ আল কুদস (বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা) জেরুজালেমকেও তেমন এ উম্মাহর সবার জন্য উন্মুক্ত করা। ইয়াহুদিরা যেমন সাইন্স, টেকনোলজিতে উন্নত, তার চেয়েও উন্নত হতে হবে মুসলমানদের। সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র যেমন ওদের কবজায়, তার চেয়েও অধিক শক্তিশালী সমরাস্ত্র থাকতে হবে মুসলিমদের অস্ত্রাগারে, তৈরি করতে হবে নিজেদের অস্ত্রকারখানায়। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আমরা করব, শ্লোগানও আমরা দেব, তবে এর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না। মিশরের মরহুম প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের লিখেছেন: ‘গলা ফাটিয়ে চিৎকারের নাম শক্তি নয়, যা কিছু সহায় সম্বল আছে তা নিয়ে গঠনমূলক কাজ করার নাম শক্তি।’ (সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন