শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আশুরার ঘটনাবলী মর্মকথা এবং আমল

এহসান বিন মুজাহির | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

মানবজাতির সূচনালগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করছে পবিত্র মহররম মাস। বিশেষ করে ঐতিহাসিক কারবালার রক্তঝরা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহররম মাস আরও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)।

কারবালার সূত্রপাত: ইসলামের ইতিহাসে কারবালার ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর মোতাবেক ৬১ হিজরির ১০ মহররম ফুরাত নদীর তীরে ইরাকের তৎকালীন রাজধানী কুফার ২৫ মাইল উত্তরে কারবালার মরুপ্রান্তরে এক মর্মন্তুদ ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। ওইদিন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নরপিশাচ সিমারের হাতে শাহাদাতবরণ করেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হজরত হোসাইন (রা.) অল্পসংখ্যক সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে জালিম শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন কারবালা প্রান্তরে। সেদিন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশি রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল। জালিম শাসক ইয়াজিদ চেয়েছিল মুসলিমজাহানের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হজরত হোসাইনের (রা.) স্বীকৃতি আদায় করে নিতে। যদি হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মেনে নিতেন এবং তার কাছে মাথানত করতেন তাহলে সেই ‘কারবালা’ আর হতো না। কিন্তু হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি এবং তার কাছে মাথা নত করেননি। তিনি জালিম শাসকের প্রতি আনুগত্য তথা সমর্থন দেয়ার চেয়ে শহিদ হওয়াই শ্রেয় মনে করেছিলেন। তাই অন্যায়-অসত্য এবং স্বৈরাচারী শাসকের কাছে তিনি মাথা নত করেননি।

আশুরার গুরুত্ব: মহররম মাসে বহু স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় বিভিন্ন দিক দিয়ে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মহররমের দশম দিবসে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে ১. আকাশ, জমিন, পাহাড়-পর্বত সব কিছুর সৃষ্টি। ২. আদম (আ.) কে সৃষ্টি । ৩. নূহ (আ.) এর মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ। ৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) এর নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ড থেকে মুক্তিলাভ। ৫. দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.) এর দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ। ৬. হজরত সুলাইমান (আ.) কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্বদান। ৭. হজরত ইউনুস (আ.) কে ৪০ দিন পর দজলা নদীতে মাছের পেট থেকে উদ্ধার। ৮. হজরত মুসা (আ.) কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা। ৯. হজরত ঈসা (আ.) এর পৃথিবীতে আগমন এবং জীবিতাবস্থায় আসমানে উত্তোলন। ১০. হজরত ইদ্রিস (আ.) কে আসমানে উত্তোলন। ১১. হজরত দাউদ (আ.) কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা। ১২. গাজওয়ায়ে খায়বার বিজয় অর্জন। ১৩. মাদায়েন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধে বিজয় অর্জন। ১৪. প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা এবং একই দিনে তাঁর জান্নাতে প্রবেশ। ১৫. হজরত আদম (আ.) কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর বিবি হাওয়া (আ.) এর সাথে আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে পুনঃসাক্ষাৎ লাভ। ১৬. হজরত ইয়াকুব (আ.) কর্তৃক হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ। ১৭. সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফে আগমন। ১৮. হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তার ৭৭ ঘনিষ্ঠজনের স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শহাদতবরণ। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১/১৩২, উসদুল গাবাহ, ১/২১ ফাতহুল বারী, ৪/২৯১ আর রাহিকুল মাখতুম ১/৬৮)।

আশুরার আমল: আশুরার কারণে মহররম মাসের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালার প্রিয় মাস মহররম। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে বিধান ও গণনা হিসেবে মাস হলো বারোটি আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। সুতরাং এ মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। (সূরা তাওবাহ : ৩৬)।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন, দেখলেন মদীনার ইয়াহুদীরা আশুরার দিবসে রোজা পালন করছে। তাদেরকে রোজা রাাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা বললো, এই দিনটি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) এবং তার সম্প্রদায় বনী ইসরাইলকে ফেরআউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং তার উপর বিজয় দান করেছেন। আর তারই শুকরিয়া হিসেবে এদিনে মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোজা রাখি। তখন রাসুল (সা.) বললেন, মুসা (আ.) এর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার। তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিগণকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম : ২৬৫৩)। তবে ইয়াহুদিরা আশুরা উপলক্ষে একদিন রোজা রাখে। তাদের রোজার সাথে যেন মুসলমানদের রোজার সাদৃশ্য না হয়, তাই মুসলমানরা আশুরার রোজার সাথে ৯ অথবা ১১ তারিখে আরো একটি রোজা বৃদ্ধি করে মোট দুইটি রোজা রাখবে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রমজানের রোজার পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হলো মহররমের রোজা। (তিরমিজি : ২৪৩৮)। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, আশুরার রোজা তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়নি বটে, কিন্তু আমি এই দিন রোজা রাখবো। যার ইচ্ছা হয় সে এই রোজা রাখতে পারো এবং ইচ্ছে হলে তা ছাড়তেও পারো। (বুখারি : ১৮৬৫)।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
ঘহডজজতজজহডহডডওডহডননহডজাও ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:২৮ এএম says : 0
ভালো ☺
Total Reply(0)
Md Abdul Mabud ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৪:২০ এএম says : 0
পবিত্র মুহরর্ম মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই আশুরা গুরুত্বপূর্ণ দিবস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। হাদীস শরীফে এই আশুরার গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে।
Total Reply(0)
Jahangir Alam ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৪:২২ এএম says : 0
বিভিন্ন যুগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে আশুরাতে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু বিশ্বজগত সৃষ্টি করেন আশুরাতে, পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টিপাত হয় আশুরাতে, জান্নাতে হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে পানি, আগুন, মাটি, বাতাস (আব্, আতশ, খাক্, বাদ) দ্বারা সৃষ্টি করে তাঁর দেহে রূহ্ (আত্মা) ফুঁকে দেয়া হয় এই আশুরাতে, আদম ও তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে যেদিন পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয় সেদিন ছিলো আশুরা, যেদিন তাঁদের তওবা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু কবুল করেন সেদিন ছিলো আশুরা, হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম মহাপ্লাবনের কারণে ৪০ দিন কিশ্তিতে ভাসমান থাকার পর মহাপ্লাবনের অবসান ঘটলে যেদিন যূদী পাহাড়ে অবতরণ করেন সেদিন ছিলো আশুরা, হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম নমরুদের অগ্নিকুন্ড হতে যেদিন মুক্তিলাভ করেন সেদিন ছিলো আশুরা, হযরত ইউনুস আলায়হিস্ সালাম মাছের পেট থেকে উদ্ধার লাভ করেন এক আশুরায়, হযরত আইয়ুব আলায়হিস্ সালাম ভীষণ রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন এক আশুরাতে, হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালাম রাজত্ব ফিরে পান আশুরাতে। হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালাম দীর্ঘকাল পর পিতা হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালামের সাথে মিলিত হন আশুরাতে। কিয়ামত হবে ভবিষ্যতের কোনো এক আশুরার শুক্রবারে।
Total Reply(0)
Jafar Anwari ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৪:২২ এএম says : 0
আশুরায় সংঘটিত বহু ঘটনা আশুরাকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেছে। সব ঘটনাকে ছাপিয়ে যে ঘটনা আশুরাকে তাৎপর্যমন্ডিত করেছে তা হলো কারবালার যুদ্ধে হযরত হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর শাহাদাতের ঘটনা।
Total Reply(0)
Jafrul Kabir ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৪:২৩ এএম says : 0
মুসলিম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই মাসকেন্দ্রিক অনেক কুসংস্কার, ভুল বিশ্বাস ও কাজের চর্চা রয়েছে মুসলিম সমাজে; যার বৃহদংশই ভিত্তিহীন।
Total Reply(0)
Habibur Rahman ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৪:২৪ এএম says : 0
স্মরণ রাখতে হবে, ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিভিন্ন কারণে। প্রাক-ইসলামি যুগেও মহররমের ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের অসংখ্য কালজয়ী ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী পুণ্যময় এ মাস।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন