রাজধানীসহ সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্লক রেইড ও অভিযানের মধ্যেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে অপহরণকারী চক্র। একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেছে। একটি দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বল প্রয়োগ ও র্যাব-পুলিশ পরিচয় দিয়ে যখন তখন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে অপহরণকারী চক্র। আদায় করছে মুক্তিপণ। ক্ষেত্রবিশেষে অপহৃতকে হত্যাও করা হচ্ছে। দিনের বেলায়ও রেহাই মিলছে না এসব চক্রের হাত থেকে। সম্প্রতি নগরীর বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এধরনের অপরাধ। একজন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ দৈনিকটির সাথে আলাপকালে বলেছেন, দেশে র্যাব-পুলিশের পরিচয়ে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একদল লোক অস্ত্র হাতে কোথাও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিলে কে আসল কে নকল তা নিশ্চিত করার সুযোগ সাধারণ মানুষ পায় না। বিশেষ করে চিহ্নিত অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দেয়। অপহরণকারী চক্র নিত্য নতুন উপায়ে তাদের কার্যসমাধা করে। তিনি মনে করেন, নিয়মিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের সূত্র উল্লেখ করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে রাজধানীতে অপহরণের শিকার হন ১৪৬ জন। চলতি বছরের ৭ মাসে অপহরণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩। এ হিসাব অনুযায়ী গত ৭ মাসে ৩ দিন অন্তর গড়ে একজনকে তুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। বলা হয়েছে, অপহরণের বিষয়ে অভিযোগ জানানো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার সুরাহা করতে পারছে না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আবার অপরাধীদের হুমকি-ধামকির কারণে অনেক ভুক্তভোগী বা তাদের স্বজনরা অভিযোগ জানাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।
অপহরণ নতুন কিছু নয়। অনেকদিন থেকেই এনিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা যেমন উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন তেমনি আন্তর্জাতিক মহলও এনিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে। বাস্তবত অপহরণ এখন নানামাত্রিক রূপ লাভ করেছে। একদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ অন্যদিকে এই বাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়ে অপহরণ। এর কোনটি কারা করছে, কারা জড়িত সেটি বুঝে ওঠা জনগণের পক্ষে এখন কার্যতই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানের ফলেও নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। দেশে অপহরণ প্রতিরোধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার বলেছিলেন সাদা পোশাকে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করবে না। সেটি সব ক্ষেত্রে পালিত হচ্ছে, সেকথা বলার উপায় নেই। সাদা পোশাকে তো বটেই ছদ্মবেশে সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতারের ঘটনার সাথে তাল মিলিয়ে অপহরণকারী চক্রও সুযোগ নিচ্ছে। বৈধ বাহিনীর এধরনের গ্রেফতার অব্যাহত থাকার ফলে যেসব অপহরণকারী আইন-শৃঙ্খলা বাহনীর নাম ব্যবহার করে অবৈধ কর্মকা- করছে তাদের চ্যালেঞ্জ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মানুষই অপহৃত হচ্ছে না, গাড়ীও অপহৃত হচ্ছে। উদ্ধারের জন্য মামলা করতে গেলে কোন কোন ক্ষেত্রে হয়রানিসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অভিযোগের পর গ্রেফতার হলেও কার্যত তা নামকাওয়াস্তে। উপরন্তু যারা অভিযোগ করেন তারা ভোগান্তির শিকার হন। দেশে নানা ধরনের অভিযান চললেও আলোচ্য আসামী বা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে কোন অভিযান পরিচালিত হবার কথা শোনা যায়নি। সামগ্রিকভাবে একারণে নাগরিক উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। গত কয়েক দিনেও এধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে প্রকাশিত খবরে। সেখানেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে, এধরনের সন্ত্রাসীদের আটক করার পরিবর্তে অনেক গুরুতর আসামী ছেড়ে দেবার ঘটনাও ঘটেছে। দিনদিনই এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মানুষ এক ধরনের আতঙ্কে রয়েছে, তার উপর অপহরণকরী চক্র আতঙ্ক আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া। কার্যতই নাগরিক জীবনে এসব এক মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যে অপহরণকারী চক্রের মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিস্ময়কর। যেখানে অভিযানে সাধারণ মানুষ তটস্থ ও শংকিত সেখানে কীভাবে অপহরণকারী চক্র সক্রিয় থাকতে পারে? বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভেবে দেখতে হবে। একদিকে অভিযানের আতঙ্ক অন্যদিকে অপহরণকারী চক্রের আতঙ্ক, এই উভয় সংকট থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেয়া অপরিহার্য। অপহরণের সাথে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত থাকে, তবে তা খতিয়ে দেখতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে কেউ অপরাধ করবে তা কোনভাবেই বরদাশত করা যায় না। অপহরণের সাথে যারাই জড়িত থাকুক তাদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। সর্বোপরি জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন