সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিদ্যুতে লোকসানের রাশ টানতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিদ্যুতখাত নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে সরকার। এক সময়ে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক ঘাটতি, দু:সহ লোডশেডিং এবং শিল্প-বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতার খেসারত দিতে হয়েছে সরকারকে। এখন সে সমস্যা কাটিয়ে বিদ্যুতে উদ্বৃত্ত হলেও আরেক সংকটের মুখোমুখী সরকার এবং ভোক্তাসাধারণ। গ্রাহক পর্যায়ে বছরে কয়েকবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়েও এ খাতে লোকসানের রাস টানা যাচ্ছে না। লোকসান কমাতে বছরে একাধিকবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর পাশাপাশি অস্বচ্ছ-অনৈতিক পন্থায়ও সাধারণ গ্রাহকদের পকেট থেকে বাড়তি অর্থ আদায়ের কোশেশ করতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি সারাদেশে বিদ্যুত গ্রাহকদের কাছ থেকে ভুতুড়ে বিল বা অস্বাভাবিক বাড়তি বিল আদায়ের যে অভিযোগ উঠেছিল তা সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। ভুল করে এসব ভতুড়ে বিল করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করলেও গত মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, ডিপিডিসি তার ৩৬টি কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে এলাকাভেদে শতকরা ১০ থেকে ৬১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি বিল আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিল। ডিপিডিসি’র এই নির্দেশনার প্রভাব দেশের পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোতেও পড়েছিল। কিন্তু মাঠ পযার্য়ে কোথাও কোথাও তা কয়েশ ভাগ বেশি বিলের খড়গ হয়ে দাঁড়ালে সারাদেশে মানুষের মধ্যে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অবশেষে বিদ্যুত বিভাগ ভুলের স্বীকারোক্তি ও সংশোধনীতে বাধ্য হয়।

গত এক দশকে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন কয়েকগুণ বেড়েছে, ঠিক একইভাবে বিদ্যুতের মূল্য এবং লোকসান বেড়েছে তার চেয়েও বেশি হারে। সরকারের অগ্রাধিকারমূলক পরিকল্পনা হিসেবে জরুরী ভিত্তিতে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে দ্বিগুণের বেশি দামে বিদ্যুত কিনে চাহিদা পুরণের ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যুত খাতের সিদ্ধান্তসমুহকে প্রশ্নের বাইরে রাখতে ২০১০ সালে দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের সাথে অস্বাভাবিক চুক্তি এবং বছরের পর বছর ধরে সে সব চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ভর্তুকি ও লোকসানের অঙ্ক ক্রমে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এখন বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি হলেও শুধুমাত্র আরপিপি চুক্তির কারণে কোনো বিদ্যুৎ না নিয়ে বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পেছনে সার্ভিস খরচের নামে সরকারকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে পিডিবি’র লোকসান ৫৮ হাজার কোটি টাকা। গড়ে বছরে লোকসানের পরিমান প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা হলেও এ হার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরসহ গত ১৩ মাসে পিডিবির নিট ট্যারিফ ঘাটতি বা লোকসান হয়েছে ৮ হাজার ৯৬৬কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য হ্রাস, দেশিয় গ্যাস ও কয়লা নির্ভর বিদ্যুতকেন্দ্র ইত্যাদি বিষয়গুলোর পাশাপাশি বছরে দু’তিনবার জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়েও লোকসানের পাল্লা এভাবে বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। এক দশকের বেশি সময়েও বিদ্যুৎখাতের মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন না হওয়া কোনো কাজের কথা নয়। দশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাড়াকল থেকে এখনি বেরিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুতখাতের সামগ্রিক উন্নয়ন, উৎপাদন. সঞ্চালন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি অনুপুঙ্খ মূল্যায়ণসহ নতুন গাইডলাইন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত পুরনো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ণ ও সক্ষমতাবৃদ্ধির পাশাপাশি নির্মীয়মান নতুন বড় বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে যথাশীঘ্র অপরারেশনে আনার মধ্য দিয়ে ডিজেল নির্ভর রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের চুক্তি থেকে সরে আসতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বহুমুখী বিকল্প থাকা ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে দেশীয় ছোটবড় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুত সরবরাহ বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি ভারত থেকে এবং নেপাল ও ভুটান থেকে স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ অবশ্যই ভাল পদক্ষেপ। এ হিসেবে নিজেদের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হওয়ার আগেই সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে চলেছে। অতএব বিদ্যুৎখাতে শ্বেতহস্তি পালনের চলমান ব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে আসা জরুরি। সেই সাথে বিদ্যুতখাতে মূল্য সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলোর প্রতি বেশি জোর দিতে হবে। দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বড় চমক সৃষ্টি করতে পারে বাংলাদেশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন