গতকাল বৃহস্পতিবার অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে একটি লোমহর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘দৈনিক ইনকিলাবের’ দ্বিতীয় প্রধান সংবাদে প্রকাশ, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিদিন গড়ে একটি করে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছে ২৯ শিশু। এদের মধ্যে চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার পর পাওয়া গেছে ছয়জনের লাশ। স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে তিনজন। বেসরকারি সংস্থা শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংগঠনটি প্রতিমাসে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিশুহত্যার হার ছিল ক্রমবর্ধমান। ২০১৫ সালে এই হার ২০১৪ সালের তুলনায় কিছুটা কমেছিল। কিন্তু চলতি বছরে প্রায় প্রতিদিনই শিশুহত্যার ঘটনা ঘটছে, যা আগের সব হত্যার হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২০৯ এবং ২০১৩ সালে থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অপহরণের পর ১১১ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আর ২০১২ সালে ৬৭ শিশু অপহরণের শিকার হয়। এদের মধ্যে ১৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। কেবল হত্যা নয়, দেশে শিশু ধর্ষণের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ২০১২ সালে ৮৫টি, ২০১৩ সালে ১৫০টি, ২০১৪ সালে ১৯৯টি এবং ২০১৫ সালে ৫২১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া অর্ধশত শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর গত চার বছরে হাজারখানেক শিশু নানাভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
গত বছরে সিলেটের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন এবং খুলনার শিশু মোঃ রাকিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার বিচার হয়েছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। রাজন হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনকে ফাঁসি ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদ- এবং রাকিব হত্যা মামলায় দুজনকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। মানুষের মনে প্রশ্ন উদয় হওয়া স্বাভাবিক যে, এই দুই শিশুহত্যার যে দ্রুত বিচার হয়েছে, তারপর শিশুহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ হ্রাস পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি না হয়ে সে অপরাধ বেড়েই চলেছে। যেমন গত মাসে ২৯ দিনে ২৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে একাধিক শিশু অপরাধ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সামিউল বা রাকিব হত্যার বিচারের দাবিতে সারাদেশে ত্বরিত গতিতে গড়ে ওঠে জনমত। সেই জনমতের চাপে সরকার দ্রত গতিতে তাদের বিচার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আর যেসব শিশুহত্যার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এত জোরাল নয়, ফলে সরকারের ওপরেও তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি। দেশের বিবেকবান রাজনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত, প্রত্যেকটি শিশুহত্যার জন্য আলাদাভাবে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে কেন? প্রত্যেকটি শিশুহত্যার বিচারের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে কেন? তাদের মতে, এটি হওয়া উচিত একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায়। এই অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা যথাযথ বলে মনে হয় না। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, নিখোঁজ বা অপহরণের পর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে, মামলা হয়েছে। মুক্তিপণ দাবির বিষয়টিও পুলিশকে জানানো হয়েছে। তারপরও ওই শিশুদের জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। ঢাকার কেরানীগঞ্জের মুগারচর থেকে গত শুক্রবার নিখোঁজ হয় পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মো. আবদুল্লাহ (১১)। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি জিডি করে পরিবার। এরপর অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পরিবারের কাছে আবদুল্লাহকে অপহরণের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরিবার বিকাশের মাধ্যমে এক লাখ টাকা পাঠায়। কিন্তু তারপরও আবদুল্লাহকে ফেরত দেয়া হয়নি। গত মঙ্গলবার আবদুল্লাহদের বাড়ির মাত্র ১০০ গজ পশ্চিমে একটি বাড়ি থেকে প্লাস্টিকের ড্রামে আবদুল্লাহর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
বেপরোয়া শিশুহত্যা এবং শিশু ধর্ষণের পেছনে যেটি প্রধান কারণ সেটি হলো সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। তাই যদি না হবে তাহলে চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে শিশুসন্তানের মা তার শিশুসন্তানকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কীভাবে? যেখানে সন্তানবাৎসল্যে মা তার নিজের জীবন বিসর্জন দেয়, সেখানে সেই একই মা নিজের সুখ-সুবিধা এবং সম্ভোগের জন্য সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কীভাবে? কেরানীগঞ্জের শিশু আবদুল্লাহর জন্য অপহরণকারীরা পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। দুই লাখ টাকা পরিশোধের পরেও অপরাধকারীদের মনে কোনো দয়া-মায়া হয়নি এবং তারা ওই নিষ্পাপ শিশুটিকে তাদের দাবি মোতাবেক অবশিষ্ট তিন লাখ টাকার জন্য হত্যা করে। এসব কারণে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, একাধিক আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন অতীব জরুরি, তেমনি অন্যদিকে মানুষের মনে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যেবোধ জাগ্রত করাও অপরিহার্য। শিশুহত্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই দুটি পদক্ষেপ পাশাপাশি গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন