শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নদীভাঙনের ভয়াবহ তান্ডব

প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার ভাঙনে ভোলা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। প্রতি বছরই ভূমি হারাচ্ছে এই দ্বীপজেলা। বর্ষা মওসুমে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করে এবং তীরবর্তী বাড়িঘর, স্থাপনা, শস্যক্ষেত্র, বাগবাগিচা গ্রাস করে। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের প্রশ্ন: আর কত গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হলে, আর কত কৃষিজমি, বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র ভাঙনের শিকার হলে ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। বাস্তবতা এই, ভাঙন রোধে প্রতি বছরই মোটা অংকের অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ভাঙন শুরু হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকেরা বাঁশ, দড়ি, বালুর বস্তা নিয়ে হাজির হয়। এরূপ ঠুনকো ব্যবস্থায় ভাঙন রোধ হয়নি। অর্থ-কড়ি পানিতে গেছে। এ মুহূর্তে সদর উপজেলার ইলিশা, রাজাপুর, কাচিয়া, ধনিয়া, শিবপুর প্রভৃতি, দৌলতখানের ভবানীপুর, সৈয়দপুর, নেয়ামতপুর, সেদিয়া, বোরহানউদ্দিনের বড় মানিকা, পক্ষীয়া, তমিজুদ্দিনের চাঁদপুর, লালমোহন লর্ড হার্ডিঞ্জ, চরফ্যাশনের নজরুলনগর, চর কুকরি মুকরি, চর পাতলা, মনপুরার সাকুবিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ভাঙনের হুমকির সম্মুখীন। এর আগে নদী গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে গাজীপুর, রামদাসপুর, মধুপুর বঙ্গের চর, নাছির মাঝি, হাইপুর, নেয়ামতপুর, বিজীপুর, মির্জাকালু প্রভৃতি ঐতিহ্যবাহী এলাকা। নামেমাত্র টিকে আছে কাচিয়া, মদনপুর, মেদুয়া, ভবানীপুর, সৈয়দপুর, মনপুরাসহ বিভিন্ন এলাকা। একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এভাবে ধীরে ধীরে নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে, এর মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে অথচ ভাঙন বোধ করে ভূমি রক্ষার স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
শুধু ভোলা নয়, ভয়াবহ নদীভাঙনের কবলে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলার নদী-তীরবর্তী এলাকা নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহীতে পদ্মার ভাঙনে সীমান্ত পর্যন্ত বদলে গেছে। গত বছর বর্ষার সময় পদ্মার দক্ষিণ সীমান্তের ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫০০ মিটার প্রস্থের ভূমিকা- হারিয়ে গেছে। এর বদলে ভারত সীমান্তে যে চর জেগেছে তা দখলে নিয়ে গেছে ভারত। চলতি বন্যায় পদ্মা বিধ্বংসী রূপ নিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে পদ্মার ভাঙনে বহু বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। দৌলতদিয়ায় ভাঙনের মুখে পড়ে ফেরিঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর যমুনার ভাঙনে বহু বাড়িঘর, ফসলি জমি ও প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেছে। উত্তরে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার প্রভৃতি নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত পরিবার বসতবাড়ি, সহায়-সম্পদ ও জমিজমা হারিয়েছে। চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাদারিপুর, ফরিদপুরে কত বাড়িঘর, জমি-স্থাপনা যে হারিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। জানা গেছে, চলমান বন্যায় শতাধিক কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো আসলে বেড়িবাঁধ বা রক্ষা বাঁধ। ভেঙে যাওয়ায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাঁধসংশ্লিষ্ট এলাকায় ভাঙন ব্যাপক রূপ নিয়েছে। বান ও ভাঙনে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে।
বান-বন্যা-নদীভাঙন আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। বন্যায় গ্রাম-জনপদ ডুবে যায়, সহায়-সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি হয় বটে, তবে বন্যার পর মানুষ উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়, বাড়িঘর মেরামত করে, ধারদেনা করে হলেও জীবন রক্ষা করে এবং এক সময় ফসল উৎপাদনে মনোনিবেশ করে। কিন্তু নদী যখন ভাঙে তখন কোনো কিছুই অবশেষ রাখে না। বাড়িঘর, জমিজিরাত, স্থাপনা, দোকানপাটÑসবকিছুই ধ্বংস করে। নদী তীরবর্তী মানুষ বসতভিটা হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে। ভূমি হারিয়ে পরিণত হয় ভূমিহীনে। এভাবে প্রতি বছর কত মানুষ যে গৃহহীন ও ভূমিহীন হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারে না। শহরে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা এবং চরাঞ্চলে মানবেতরভাবে জীবনযাপনকারী মানুষের সংখ্যা থেকে সেটা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। প্রতিবছর বন্যা প্রতিরোধ, নদীভাঙন রোধ, বেড়িবাঁধ মেরামত ইত্যাদিতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যয় হয়। ওই অর্থ কোথায় যায়, কী হয়, তার হিসাব পাওয়া যায় না। বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বন্যা, নদীভাঙন ও বাঁধভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। জনগণের অর্থ নির্বিচারে অপচয় ও লুটপাটের এমন নজির কোনো দেশে দেখতে পাওয়া যায় না। দেশে উন্নয়নের ডামাডোল চলছে। বড় বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার চলছে। উন্নয়নের এই গীতবাদ্যের পাশাপাশি মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ ও সর্বস্ব হারিয়ে পথের ফকিরে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে। উন্নয়ন কথা নদী তীরবর্তী, উপকূলীয় ও চরাঞ্চলের মানুষের জন্য কোনো শুভ বার্তা দিচ্ছে না। আসলে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষেরই। তাদের সুরক্ষা ও নিরাপদ করা সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। সরকারকে এদিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বন্যা, নদীভাঙন ও বাঁধভাঙনের তান্ডব থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে, ব্যাপক বরাদ্দ দিতে হবে এবং বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন