আহমদুল ইসলাম চৌধুরী : পবিত্র মাহে রমজানের পর থেকে পর্যায়ক্রমে মহান আল্লাহ পাকের দাওয়াতী মেহমান হজযাত্রীগণ পবিত্র নগরী মক্কা মোকররমায় পৌঁছতে থাকবেন। আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে নবীপাক (সা.) দিকনির্দেশনা মতে হজ পালিত হয়ে আসছে। হজ তিন প্রকার : এফরাদ, তামত্তো ও কেরান। এ তিন প্রকার হজ কার্যক্রম চলবে ৬ দিনব্যাপী। অর্থাৎ জিলহজের ৮ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানকালে ৭ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৬ দিনব্যাপী হজযাত্রীগণ হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে থাকেন যা ধর্মমতে গ্রহণযোগ্য ও বিবেচিত।
অতএব, ৭ জিলহজকে সামনে রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী আকাশপথে, সাগরপথে ও স্থলপথে সউদী আরব পৌঁছবে এবং অভীষ্ট মক্কা মোকররমায় অবস্থান নেবেন। যারা হজের আগে মদিনা মুনাওয়ারা জেয়ারতে গেছেন তারাও ৭ জিলহজ বা তার পূর্বে মক্কা মোকররমা পৌঁছে যাবেন। যারা যাননি তারা হজের পর পবিত্র মদীনায় যাবেন। সেখানে সম্ভব হলে ৮ দিন থাকবেন, ৪০ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নববীতে পড়ার জন্য। যতবার পারেন মহানবী (সা.)-এর রওজা শরীফ জিয়ারত করবেন। জিলহজ মাসের ১ তারিখ থেকে মক্কা মোকররমায় সমাগম বাড়তে থাকবে। সমগ্র মক্কা মোকররমা শহর মহান আল্লাহ পাকের মেহমানকে বুকে ধারণ করে রাতদিন জেগে থাকবে। মনে হবে প্রায় ২০/২৫ লক্ষ হজযাত্রীর কোলাহলে মক্কা মোকররমা শহর উৎসবে মেতে ওঠে। হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন দোকানাদিসহ যাবতীয় জরুরি সার্ভিস তখন রাতদিন খোলা থাকবে। সউদী সরকারের তীক্ষè দৃষ্টি নিবন্ধ থাকবে মক্কা মোকররমার প্রতি। হজযাত্রী বহনের গাড়ির পাশাপাশি দৈনিক শত শত মালবাহী গাড়ি জেদ্দাসহ সউদী আরবের বিভিন্ন শহর থেকে মক্কা মোকররমা প্রবেশ করবে হজযাত্রীগণের প্রয়োজনের তাগিদে। তন্মধ্যে পানি ও খাবার অন্যতম। আইনশৃঙ্খলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সউদী সরকার বিশ্বে প্রশংসার দাবিদার। মোয়াল্লেমগণ ও তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যস্ততাও ধারণাতীত বেড়ে যাবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২/৩ ঘণ্টা ঘুমাতে পারলে তা হবে বেশি বিশ্রাম নেয়া। জিলহজের ৬/৭ তারিখের বিশাল জেদ্দা নগরী থেকে মক্কা মোকররমার প্রতি বাঁধভাঙ্গা মানবঢল নামবে। তাদের সউদী সরকার ঠোকাতে পারে না মক্কা মোকররমার নিকটতম শহর বলে। তেমনি অসংখ্য নরনারী রিয়াদ, দাম্মাম, তায়েফ, আবাহা ইত্যাদি বড় বড় শহর থেকে সউদী আইন ও কড়াকড়ি সত্তে¡ও মক্কা মোকররামায় প্রবেশ করবে পবিত্র হজের উদ্দেশ্যে। যদি ৬/৭ তারিখ মক্কা মোকররমা পৌঁছতে না পারে তবে ৮ জিলহজ মিনায় পৌঁছবে। তাও যদি সম্ভব না হয় তবে ৯ জিলহজ সরাসরি আরাফাতে গিয়ে পৌঁছবে সউদী আরবে অবস্থানরত আরব, অনারব লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হজপালনেচ্ছু নরনারী। সউদী আরবের অভ্যন্তরীণ এ হজযাত্রীর সংখ্যা কম করে হলেও ১০/১৫ লাখের বেশি বাদে কম হবে বলে মনে হয় না। সাধারণত বিদেশ থেকে সউদী হজ সার্ভিস চার্জ প্রদান করে মক্কা মোকররমায় অবস্থানরত হাজিরা ৬ দিনব্যাপী হজ করবেন মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে।
সে কারণে কাফেলা/এজেন্সি প্রধান বা তার সহকারীরা ঘন ঘন যার যার মোয়াল্লেম অফিসে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। হজযাত্রীগণ ৭ জিলহজ সকাল থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকে ৬ দিনব্যাপী হজ কার্যক্রম ঠিকভাবে পালন করতে পারবেন কি-না এ নিয়ে। কাফেলা এজেন্সিরা হজযাত্রীগণকে দিকনির্দেশনা দিতে থাকবেন। ৭ জিলহজ খানায়কাবায় হজের বিশেষ খুৎবা প্রদান করা হয়ে থাকে। সউদী হজ কর্তৃপক্ষ মোয়াল্লেমগণকে ৬ দিনব্যাপী হজযাত্রী পরিবহনের জন্য বাস প্রদান করবেন। এ লক্ষ্যে সউদী সরকার সারাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাস এবং বিদেশ থেকে ড্রাইভার মক্কা মোকররমা এনে থাকে। তবে সরকার মোয়াল্লেমের চাহিদার চেয়ে অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশের কম বাদে বেশি বাস সরবরাহ করে না। যেহেতু মক্কা মোকররমা থেকে মিনা-আরাফাত-মুজদালেফা-মিনা কত বাস চলাচল করতে পারবে তারও একটা সীমা আছে। কাজেই মোয়াল্লেমগণকে যে পাঁচ দিনব্যাপী হজ কার্যক্রমে বাসের একাধিক ট্রিপ দিতে হয়। ৮ জিলহজ বাদ ফজর মক্কা মোকররমা থেকে মিনা গমন করা এবং পরপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সুন্নাত অর্থাৎ জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর। কিন্তু বাসের ট্রিপ দিতে হবে বিধায় মোয়াল্লেমগণ বাধ্য হয়ে ৭ তারিখ বাদ এশা থেকে মক্কা মোকররমা হতে হাজীগণকে মিনা নেয়া শুরু করে। এ ব্যস্ততা সারা রাতব্যাপী চলবে। এ ট্রিপ শেষ হতে হতে অনেক সময় সকাল ৮/৯টাও হয়ে যায়।
অধিকাংশ হজযাত্রী নতুন এবং মিনায় মোয়াল্লেমের তাঁবুর অবস্থান নির্ণয় করা কষ্ট হতে পারে মনে করে ৭ জিলহজ বাদ এশা হতে মক্কা মোকাররমা থেকে মিনা পৌঁছা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে কাফেলা/এজেন্সিরা সহযোগিতা করে থাকে। যেহেতু সারা রাতব্যাপী মক্কা মোকররমা থেকে বাসের ট্রিপ চলবে অতএব, মক্কা মোকররমা থেকে মোয়াল্লেম বাসে মিনা মোয়াল্লেম তাঁবুতে পৌঁছতে তেমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। তখন বাসে বড় অক্ষরে আরবি ও ইংরেজিতে মোয়াল্লেম নম্বরের স্টিকার লাগানো হয়। অতএব, ঐ সময় মোয়াল্লেম নামের চেয়ে মোয়াল্লেম নম্বর মুখ্য হয়ে যায়। কাজেই আপনি কত নম্বর মোয়াল্লেমের হাজি তা আপনার অবশ্যই জানা থাকতে হবে। যেহেতু আকৃতি দেখে বুঝা যাবে না অধিকাংশ বাস একই রং ও আকৃতির বিধায়।
আমাদের দেশে অধিকাংশ হজযাত্রী তামত্তো হজ করে থাকেন বিধায় তারা মক্কা মোকররমা পৌঁছে ওমরা শেষ করে এহরামমুক্ত থাকেন। অতএব তাদের ৭ জিলহজ পুনঃ হজের নিয়তে এহরাম পরে নিতে হবে (ফরজ)। অপরদিকে এফরাদ ও কেরান হজযাত্রীরা এহরাম পরা অবস্থায় আছেন বিধায় পুনঃ এহরাম পরা ও নিয়তের কোন প্রশ্নে আসে না। কাফেলা/এজেন্সির দিকনির্দেশনায় ৬ দিনের ব্যবহারের কাপড়সহ ছোট ব্যাগ নিয়ে ৭ জিলহজ বিকেল থেকে তৈরি থাকা শ্রেয় যাতে করে বাদ এশা মোয়াল্লেম অফিসে বা নিজ দালানের সামনে বাসে উঠতে সহজ হয়। রাতের খাবার নিজ দালানে খাওয়া তথা মক্কা মোকাররমায় খেয়ে নেয়া শ্রেয় ঃ বাদ এশা মোয়াল্লেম বাসে করে মক্কা মোকাররমা থেকে চলে যাবেন মিনায় মোয়াল্লেম তাঁবুতে। মিনায় ব্যবস্থাপনা ধারণাতীত আরামদায়ক হয়েছে। যারা মাত্র ৮/১০ বছর আগে হজ করেছেন তারাও মিনায় অবস্থানের ব্যবস্থাপনা দেখে চমকিত না হয়ে পারবেন বলে মনে হয় না। নিচে নতুন তকতকে ও চকচকে কার্পেট, উপরে ফায়ার প্রæফ তাঁবু; সাথে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত টয়লেট পানিসহ। যে সমস্ত হজযাত্রী আগে হজ করেছেন এবং মিনা ভালভাবে চিনতে পারেন তাঁরা ৭ জিলহজ রাত্রে না গিয়ে সুন্নত মতে ৮ জিলহজ সকালে মক্কা মোকাররমা থেকে মিনা যেতে পারেন। ৮ জিলহজ মিনায় অবস্থানের সময় নামাজ পড়া ও খাওয়া-দাওয়া বাদে হজের কোন আহকাম নেই।
একালে মিনার স্থলে মুজদালেফায় অবস্থান নিতে হচ্ছে মিনায় জায়গা সংকুলানের অভাবে বর্তমানকালে সউদীরাসহ আরবীয় শেখেরাও সউদী নিয়ম মেনে মোয়াল্লেম তাঁবুতে অবস্থান নিয়ে হজ করতে হচ্ছে। তাদের বড় আয়তনের ব্যবস্থাপনাদিতে গিয়ে এবং হাজির সংখ্যাধিক্যহেতু মিনার এরিয়ায় জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশী সরকারি হাজি ও ২/১টি এজেন্সির হাজি বাদে বাকিসব হাজি মিনার স্থলে মুজদালেফায় অবস্থান নিতে হবে। এ অবস্থানকে গ্রহণযোগ্য বলে সউদী মুফতিগণের ফতোয়া রয়েছে।
সউদী সরকার ও বড় বড় শেখগণ বিভিন্ন মানের ও আকৃতির লক্ষ লক্ষ খাবার প্যাকেট ফ্রি বিতরণ করবে। ঐসব প্যাকেট মানসম্পন্ন এবং শরীরের উপযোগী। অতএব, প্যাকেটের শুষ্ক খাবার খেতে সচেষ্ট থাকবেন আশা করি- বিশেষ করে আরাফাত ও মুজদালেফায়। ৮ জিলহজ বাদ এশা অনেকটা রাত ১২টার পর থেকে মোয়াল্লেমগণ হজযাত্রীগণকে মিনার তাঁবু থেকে আরাফাত নেয়া শুরু করে এবং তা সারারাত পার হয়ে সকাল পর্যন্ত চলবে। কাজেই কাফেলা/এজেন্সিরা হাজিগণকে রাতেই মিনা থেকে আরাফাত নিয়ে যায়। আরাফাতে দিনে অবস্থান বিধায় খোলা তাঁবু ও খোলা বিছানা বলা যায়। তবে সরকারি টয়লেট ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল বলতে পারি। ৯ জিলহজ সকাল ৭/৮টার পর থেকে টয়লেটের প্রতি দরজায় দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। এ লাইন স্থানভেদে ৫/৭ জন থেকে ১৫/২০ জন পর্যন্ত হয়ে থাকে। ৯ জিলহজ সকালে গোসল করতে পারাটা সুন্নত। এহরাম অবস্থায় গোসলে শুধুমাত্র শরীরের উপর পানি ঢেলে দেওয়া, যাতে সারা শরীর ভিজে যায়। সাবানতো নয়ই-হাত দিয়ে শরীর মাখামাখিও করা যাবে না। তেমনি পরনের যে এহরাম কাপড় ভিজে গেছে ঐ কাপড় এহরাম পরা অবস্থায় বিধায় অপরিষ্কার হলেও তিনবার চিপে প্রয়োজনে পাক করা যাবে।
৯ জিলহজ আরাফাতে অবস্থান করা (ফরজ)। সূর্যাস্তের পরই সেখান থেকে বের হওয়া যাবে। (ওয়াজিব) জোহর ও আসর এক সাথে কসর করে পড়বেন। সূর্যাস্তের পর মাগরিব পড়া যাবে না। মুজদালেফায় রওনা দিতে হবে যতদেরিই হোক সেখানে পৌঁছে এক সাথে মাগরিব ও এশা পড়তে হবে। এখানে ৪৯টি কংকর সংগ্রহ করতে হবে। শেষরাতে দোয়া কবুল হয়, এখানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হবে। (ওয়াজিব) ফজরের পরপরই মিনায় ফিরতে হবে। এ দিন অর্থাৎ ১০ জিলহজ বড় জামারায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। (ওয়াজিব) এরপর কোরবানী হয়েছে (ওয়াজিব) শিওর হয়ে মাথা কামাতে বা চুল ছোট করতে হবে। (ওয়াজিব) পরে ১১ ও ১২ তারিখ তিন জামারায় ৭টি করে ২১টি কংকর মারতে হবে। (ওয়াজিব) ১০ তারিখে প্রথম কংকর নিক্ষেপের পর মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত করতে হবে (ফরজ) পরে সাফামারওয়া সাঈ করতে হবে (ওয়াজিব)। হজ বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) করে দেশে ফেরার অপেক্ষা। হজে বিশেষ কোন দোয়া নেই। আল্লাহর কাছে সব দোয়াই করা যায়। তেলাওয়াত ও জিকির করতে হয় বেশি বেশি। হজের প্রদান দোয়া লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন