বান বর্ষণ অভিশাপ নয় আশীর্বাদও বটে। বন্যা কিছু মানুষকে শুধু কাঁদায় না যাবার সময় যা রেখে যায় তাতে সোনা ফলে আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, তিস্তা, যমুনা অববাহিকায় হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। নদ-নদী গুলোর সাথে সখ্যতা করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা আবর্তিত হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে নদী মাতৃক বাংলাদেশের নদী গুলোয় দুকূল ছাপিয়ে যেমন বন্যা এসেছে। আবার তা সরেও গেছে।
বন্যায় নদী তীরের কিছু বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্যার পানিতে আসা পলিতে ফসলী জমি উর্বর হয়েছে। সেই পলিতে সোনা ফলেছে। সব ক্ষতি পুষিয়ে গেছে। আবহমান কাল থেকেই নদী বাংলাদেশের জনজীবনে সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না আনন্দ-বেদনা আশা-হতাশা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন যে বন্যা হচ্ছে তা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নয় এটি মানবসৃষ্ট। আবহাওয়া পরিবর্তনের যে কথা বলা হচ্ছে সেটিও মানবসৃষ্ট। উন্নয়নের নামে নদ নদী খাল বিল জলাশয়ের উপর নানামুখী তান্ডব চালানোর ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়ে পানিবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। নদী খাল বিল ভরাট হয়েছে। দখল হয়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে।
বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, আমাদের নদীগুলোর ৫৪টি এসেছে ভারত হয়ে। ভারতের পানি জল্লাদরা অভিন্ন এসব নদীর বুকে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ব্যারেজ দেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের নদ নদীর মরণ দশা শুরু। বিশেষ করে গঙ্গার উপর ফারাক্কা আর তিস্তার উপর গজলডোবা বাঁধ দেয়ায় উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর দফারফা করে ছেড়েছে। বালি জমতে জমতে নাব্যতা হারিয়েছে। শুকনো মওসুমে ভাটির দেশকে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারলেও বর্ষার সময় তাদের বন্যার চাপ কমাতে সবকটি গেট খুলে দেয়। নাব্যতা না থাকায় আমাদের নদীগুলো একটুতেই দুকূল ছাপিয়ে চলে। ভাসায় জনপদ ফসলের ক্ষেত আর ভাঙে নদীর পাড় ঘরবাড়ি। নদী দু’তীর ছাপিয়ে চলার কারণে বন্যা হয়। সে বানের পানিতে জমে পলি। এই পলিতে আবাদ হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মুখে হাসি ফোঁটায়।
তাছাড়া এখন ফসলী জমি কোন সময় আর খালি থাকে না। রাসয়নিক সারের ব্যবহারে কুপোকাত এর উর্বরা শক্তি। একবার বন্যায় ডোবার ফলে যে পলি পড়ে তাতে তিন বছরের জন্য প্রাকৃতিকভাবেই উর্বরা শক্তি বেড়ে যায়। তাই বন্যা আমাদের প্রয়োজন। তাছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ জীব বৈচিত্রের সম্ভার ঘটে। বান বর্ষণের পানি ধরে রাখতে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প এখন সময়ের দাবি। নদী বিলের নাব্যতা বাড়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সক্রিয় হতে হবে।
কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি উন্নয়নের রুপকার বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প। শুরুতে রাজশাহী অঞ্চলের পঁচিশ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র প্রকল্প এখন উত্তরাঞ্চলে ষোল জেলা নিয়ে কাজ করছে। এক ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রুপান্তর করেছে সেচ ব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে। ঠা ঠা বরেন্দ্র নামে পরিচিত মরু সাদৃশ্য ভূমির মানুষের জীবন যাত্রা পাল্টে দিয়েছে। পাঁচলাখ কৃষকের ভাগ্যেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
প্রকল্প এলাকায় প্রায় ষোল হাজার গভীর নলকূপ বসিয়ে পৌনে ছয়লাখ হেক্টর জমিতে সেচ ব্যবস্থাপনার আওতায় এনেছে। এক ফসলী জমির স্থলে তিন ফসলী হওয়া খাদ্য শষ্যের উৎপাদন বেড়েছে। এখন বছরে প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য শস্য উৎপাদন করছে। বৃক্ষশূন্য বরেন্দ্র এলাকায় বনায়ন করেছে আড়াই কোটির বেশী। রাস্তাঘাট নির্মাণ, খাল খাড়ি পুকুরের সংষ্কারের কারনে ঠা ঠা বরেন্দ্র ভূমির মানুষের জীবন যাত্রার ছবিও স্নিগ্ধ হচ্ছে।
খাদ্যের প্রয়োজন হাজার হাজার গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলনের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে। পানির স্তর স্থান ভেদে ৯০ ফুট থেকে ১৪০ ফুটের মধ্যে ওঠানামা করে। বর্ষা বাদলে প্রতিবছর খানিকটা রিচার্জ হয়। ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে ভূ-পরিস্থ পানি ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। এখন নতুন করে আর গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে না। বরং বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চারশোর বেশী খাড়ি বা খাল যার দৈর্ঘ্য চার হাজার কিলোমিটার। আর খাস পুকুর রয়েছে চৌদ্দ হাজার। যা এক সময় বরেন্দ্রের জন্য ছিল রক্ত সঞ্চালন নাড়ির মত। পরবর্তীতে হাজা মজাতে রুপ নেয়।
এখন বর্ষণ আর বন্যার পানি সংরক্ষণে এ ভূ-গর্ভস্থ পানির পুনঃভরণের জন্য কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশী খাড়ি খনন করা হয়েছে। ক্রস ড্যামের মাধ্যমে পানি ধরে রাখা হচ্ছে। পুকুর খনন করা হয়েছে তিন হাজারের বেশী। এ বছরও আরো সাতশো পুকুর খননের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু খাস পুকুর গুলো প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় খনন কাজে বিঘ্ন ঘটছে। যতটুকু খাড়ি পুকুর খনন করা হয়েছে সে পানি দিয়ে একলাখ হেক্টর জমিতে সম্পূরক সেচ দেয়া হচ্ছে।
বরেন্দ্র প্রকল্পের রাজশাহী জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ ও ঠাকুরগাঁও জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলমের সাথে আলাপকালে তারা এসব তথ্য দিয়ে বলেন, আমরা বর্ষণ ও বানের পানি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করছি। বন্যা ও ভারী বর্ষণ আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এবার আমন আবাদে কৃষকের কোন পানি লাগেনি। পলি পড়ায় শাক-সবজিসহ অন্য ফসল আবাদে সহায়ক হয়েছে। তাছাড়া বন্যা প্রলম্বিত হওয়ায় পানি রিচার্জ বেশী হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল যিনি দীর্ঘদিন ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে কাজ করছেন। জাতীয় গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির অন্যতম সদস্য। তার সাথে আলাপকালে বলেন, আমরা বান বর্ষণের পানি ধরে রাখতে পারছি না। নদী নালা খাল বিলে এসব পানি ধরে রাখা গেলে উপকার হতো। এ পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি।
সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এবার গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র ভ্যালিতে বৃষ্টি বেশী হয়েছে। দেশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আড়াই হাজার মি. মি.। কিন্তু এবার বরেন্দ্র অঞ্চলে হয়েছে দুই হাজার মিলিমিটার। এ পানি আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আর নদী বিধৌত অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ দেখা গেছে। বন্যায় ক্ষতি হলেও উপকারও হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন