শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পাকিস্তানে নিন্দনীয় বর্বরোচিত হামলা

প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে একটি বেসামরিক হাসপাতালে আত্মঘাতী বর্বর হামলায় ৭০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগ আইনজীবী। দুইজন সাংবাদিকও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৩০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত সোমবার বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেইটে এই হামলা চালানো হয়। কেউ কেউ এই হামলাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে মনে করছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলার সময়ে চারদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অনেকে জীবন বাঁচানোর জন্য পালাতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে যায়। হাসপাতালের মেঝে রক্তে ভেসে যায়। অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইন, প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ, সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিসহ দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ। এই ভয়াবহ হামলার সাথে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং(র) জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী সানাউল্লাহ জেহরি। ডন, রয়টার্স, দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ও দ্যা ন্যাশনের উদ্ধৃতি দিয়ে হামলা সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তান তেহরিক-ই তালেবান এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। পরে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসও এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এদিকে কোয়েটার হামলার রেশ না কাটতেই খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে গত সোববার সন্ধ্যায় বোমা হামলায় অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ বলেছেন, কাউকেই প্রদেশটির শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে দেয়া হবে না। পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এ হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক সপ্তাহের শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে। লাহোর হাইকোর্টের আইজীবীরা হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে।
এবারের হামলা সম্পর্কে বেলুচিস্তানের স্বরাষ্ট্র সচিব আকবর হারিফাল বলেছেন, সকালে বেলুচিস্তান বার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার কাসিকে দুই অজ্ঞাত বন্দুকধারি মঙ্গল চৌকের মান্নুজান রোডে গুলি করে হত্যা করে। তার লাশ আলোচ্য হাসপাতালে আনা হলে জরুরি বিভাগে প্রবেশের পথেই আত্মঘাতী হামলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ফরিদউল্লাহ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, গুলিতে আহত আইনজীবী কাসির সঙ্গে তার প্রিয়জনের অনেকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করতে যান। ঠিক সেই সময়েই হামলা চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, বোমার সঙ্গে গুলির শব্দও শোনা গেছে। টেলিভিশনের ফুটেজেও দেখা গেছে জরুরি বিভাগের জানালা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই বিবরণী থেকে স্পষ্ট যে হামলাকারীরা অনুসরণ করেছে। এর আগে গত জুনে ইউনিভার্সিটি অব বেলুচিস্তানের আইন বিভাগের অধ্যক্ষ আমানুল্লাহ আচাকজাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। গত এক দশক ধরে আয়তনে পাকিস্তানের বড় প্রদেশ বেলুচিস্তানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আফগানিস্তান এবং ইরান সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই প্রদেশে বিচ্ছন্নতাবাদীরা আন্দোলন করছে। পাকিস্তানে এ ধরনের আত্মঘাতী হামলা এই প্রথম নয় বরং অনেকটাই যেন নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে এ ধরনের বহু হামলার ঘটনায় অনেকের প্রাণ গিয়েছে। এ বছরের শুরুতেই লাহোরে শিশুদের একটি পার্কে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে অন্তত ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এক বন্দুকযুদ্ধে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের চারসাড্ডা জেলায় বাচাখান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৫ জন ছাত্র-শিক্ষক নিহত হয়েছে। ২০১৫ সালে পেশোয়ারে একটি মসজিদে বোমা ও বন্দুক হামলায় কমপক্ষে ২২ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়েছিল। প্রকাশিত খবর অনুযায়ি ওই বছর দেশটির নিষিদ্ধ ঘোষিত তাহরিকে তালেবান বা টিটিপির হামলায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। ওই বছর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুজা খানজাদা নিজের অফিসে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন। কিংবদন্তি ক্রিকেটার ওয়াসিম আক্রাম হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে যান। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এক স্কুলে হামলা করে ১৩৪ জন শিক্ষক ও ছাত্রকে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। এ ধরনের হামলা শুধু স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল পার্কে নয় বরং বহু সুরক্ষিত স্থান ও স্থাপনাতেও ঘটছে। এবারের হামলা সম্পর্কে বলা হয়েছে নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। কেন এবং কি কারণে বার বার এ ধরনের হামলাগুলো ঘটছে তা নিয়েও বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এ ধরনের বর্বরোচিত হামলার ফলে দেশটির আর্থ-সামাজিক অবস্থা একরকম ভেঙে পড়ার উপক্রম। এবারের হামলা সম্পর্কে একদিকে যেমনি দায় স্বীকার করা হয়েছে, অন্যদিকে হামলাকারিদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে বলে সেখানকার সরকারিমহল স্বীকার করেছেন। কেন সেখানে আইনজীবীরা টার্গেটে পরিণত হয়েছে সেটিও দেখার বিষয়। সবমিলে একথাই সত্যি যে, এ ধরনের হামলার ফলে কার্যত মানুষের নিন্দা ও ঘৃণা ছাড়া কিছুই অর্জিত হয় না হবার কথাও নয়।
শুধু আলোচ্য ঘটনাই নয় বিশ্বের যেখানেই এ ধরনের ন্যক্কারজনক বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটছে আমরা তার তীব্র ও কঠোর নিন্দা জানাই। আমরা মনে করি আত্মঘাতী হামলা বা এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা সমস্যা সমাধানের কোন পথ হতে পারে না। এতে কেবল নিরীহ মানুষের মৃত্যুই হয়। হত্যার মধ্য দিয়ে যেসব পরিবার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা স্থায়ীভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে যার সুদূরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা থাকে। হত্যা মৃত্যু হত্যাকেই ডেকে আনে। কেবল নিন্দা কুড়ানোর মধ্য দিয়ে কোনকিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। এটা সকলেরই মনে রাখা দরকার হিংসা-বিদ্বেষ পরিস্থিতিকে ক্রমাগত অবনতিশীল করে। এটা সাধারণভাবে যেমনি ঘৃণ্য তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতেও অগ্রহণযোগ্য ও জঘন্য অপরাধ। মনে রাখতে হবে যারা হত্যার পথে সমাধান আশা করে তারা ভ্রান্তপথে রয়েছে। পাকিস্তানে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে, যে কোন সমস্যা ও দাবি-দাওয়া আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। আলোচ্য ক্ষেত্রে তদন্তের যে কথা বলা হয়েছে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে এর সন্তোষজনক সমাধানে সকলে আন্তরিক হবেন- এটাই শান্তিবাদী মানুষের প্রত্যাশা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন