৯ জিলহজ আরাফাতে অবস্থান করা (ফরজ)। সূর্যাস্তের পরই সেখান থেকে বের হওয়া যাবে। (ওয়াজিব) জোহর ও আসর এক সাথে কসর করে পড়বেন। সূর্যাস্তের পর মাগরিব পড়া যাবে না। মুজদালেফায় রওনা দিতে হবে যতদেরিই হোক সেখানে পৌঁছে এক সাথে মাগরিব ও এশা পড়তে হবে। এখানে ৪৯টি কংকর সংগ্রহ করতে হবে। শেষরাতে দোয়া কবুল হয়, এখানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হবে। (ওয়াজিব) ফজরের পরপরই মিনায় ফিরতে হবে। এ দিন অর্থাৎ ১০ জিলহজ বড় জামারায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। (ওয়াজিব) এরপর কোরবানী হয়েছে (ওয়াজিব) শিওর হয়ে মাথা কামাতে বা চুল ছোট করতে হবে। (ওয়াজিব) পরে ১১ ও ১২ তারিখ তিন জামারায় ৭টি করে ২১টি কংকর মারতে হবে। (ওয়াজিব) ১০ তারিখে প্রথম কংকর নিক্ষেপের পর মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত করতে হবে (ফরজ) পরে সাফামারওয়া সাঈ করতে হবে (ওয়াজিব)। হজ বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) করে দেশে ফেরার অপেক্ষা। হজে বিশেষ কোন দোয়া নেই। আল্লাহর কাছে সব দোয়াই করা যায়। তেলাওয়াত ও জিকির করতে হয় বেশি বেশি।
হজের প্রদান দোয়া লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।
আহমদ মুসতাঈন খান : বিশ্বের নানাদেশ থেকে লাখো হজযাত্রী এখন মক্কায় সমবেত হচ্ছেন। ৭ জিলহজ কার্যক্রম শুরু হলে তারা সবাই মিনা থেকে যাবেন আরাফাতে। মোয়াল্লেমের গাড়িতে সুশৃঙ্খলভাবে যাওয়াই নিয়ম। ইচ্ছা করলে কেউ হাজারো নরনারীর সাথে পায়ে হেঁটে আরাফাতে অবস্থান নিতে পারেন (ফরজ) এবং সূর্যাস্তের পরপর মাত্র ৩/৪ কিলোমিটার হেঁটে মুজদালিফায় এসে রাত কাটাতে পারবেন। (ওয়াজিব) তখন সুন্নত তরতীবমতে হজ করা হল। একালে দেশে লাখ লাখ নরনারী এর চেয়ে বেশি হেঁটে মর্নিং ওয়াক করে থাকেন।
আরাফাতে এক আজান দু’একামতে দুই রাকাত করে চার রাকাত কসর নামাজ পড়বেন। আরাফাতের বুকে তথা অবস্থানকারী বাকি ২৬/২৭ লাখ হাজি যার যার অবস্থানস্থলে জোহর ওয়াক্তে জোহর, আসর ওয়াক্তে আসর নামাজ পড়বেন- বিশেষ করে আমাদের দেশীয় হানাফী মাজহাবের হাজিগণ। আরাফাত থেকে বাদ আসর প্রস্তুতি নিতে হয় মুজদালিফা রওনা হতে। যেহেতু এক্ষেত্রে বাসের একাধিক ট্রিপ ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ প্রথম ট্রিপ আরাফাত থেকে সূর্যাস্তের পর মোয়াল্লেম বাস মাত্র ৪/৫ কিলোমিটার দূরত্বে মুজদালিফা পৌঁছতে অনেক সময় গভীর রাত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ঐ বাস পুনঃ আরাফাত ফিরে এসে ২য় ট্রিপ দিতে দিতে সকাল হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কাজেই আরাফাতে হাজিগণ আসরের পর থেকে বাসের সিট ঠিক করতে তৎপরতা শুরু করে দিতে বাধ্য হন এবং যারা বাসের ছাদেও সীট না পান তারা হাহুতাশে পড়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, হাজিরা অনন্যোপায় হয়ে বাসের সীট পেতে তৎপরতা শুরু করে দিতে বাধ্য হন। আরাফাত ময়দানে ঐদিন দোয়া কবুলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়। ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের পরপর মুজদালেফার ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। যারা মোয়াল্লেম বাস না পান তারা হেঁটে উত্তরদিকে এসে প্রাইভেট কোন না কোন গাড়িতে করে মুজদালিফা পৌঁছবেন। শারীরিক সক্ষম হলে পায়ে হেঁটে আসতে পারেন। মুজদালেফা পৌঁছে এশা ওয়াক্তে মাগরিব ও এশার ফরজ নামাজ পড়বেন। অতঃপর সুন্নত ও বিতর পড়বেন। তারপর ৪৯টি ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে নেবেন। তারপর খাবার খাবেন। (একালে অনেক সেবা সংস্থা হাজিগণকে পাথরের প্যাকেট সরবরাহ করে থাকে)। অতঃপর খোলা আকাশে নিজ উদ্যোগে রাত্রের নিদ্রা বা বিশ্রাম নেবেন।
ভোররাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে সুবেহ সাদেক হলে ফজরের নামাজ পড়ে নেবেন এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন আকাশ ফর্সা হওয়ার জন্য। মুজদালিফায় রাত্রে আগমণ এবং সূর্য উঠার আগে ত্যাগ অতএব, হারিয়ে যাবার ভয় বেশি। বিশেষ করে টয়লেটে গিয়ে ফিরে স্থান তালাশ করে না পাওয়া বা খাবার তালাশে গিয়ে ঐ একই স্থান তালাশ করে না পাওয়া।
মুজদালিফায়ও আরাফাতের মত টয়লেট অপর্যাপ্ত। স্থানভেদে প্রতি দরজায় ৫/৭ জন থেকে ১৫/২০ জন। আশা করি সউদী সরকার আরাফাত ও মুজদালিফায় টয়লেট বাড়াবার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। মুজদালিফা ও মিনা কাছাকাছি। মধ্যখানে মাত্র ৩/৪ শত মিটার আল্লাহ পাকের গজবের স্থান। ইয়েমেনের আবরাহ বাদশাহ কাবাঘর ধ্বংস করতে এসে নিজে ধ্বংস হয়ে যায় ঐ স্থানে। মুজদালিফা থেকে ১০ জিলহজ ভোরে মোয়াল্লেম বাসে বা নিজ উদ্যোগে মিনায় মোয়াল্লেম তাঁবুতে পৌঁছবেন।
১০ জিলহজ হজযাত্রীগণকে পরপর ৪টি কষ্টসাধ্য কাজ সম্পাদন করতে হয়। এমনিতেই আমাদের বাংলাদেশীরা শারীরিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির, তাছাড়া ৭ তারিখ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত তিন দিবাগত রাতে স্বাভাবিক নিদ্রা যেতে না পারায়, মিনা ও আরাফাতের কষ্ট ও স্বাভাবিক অবস্থান না হওয়ায় আরাফাত ও মুজদালিফা ঘুরে আসতে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বয়স্ক ও মহিলারা খুবই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মিনায় পৌঁছে মোয়াল্লেমের তাঁবুতে ব্যাগ রেখে প্রথমে একমাত্র বড় জামারাতে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। (ওয়াজিব) আপনার সাথে সক্ষম মহিলা থাকলে একসাথে পাথর নিক্ষেপের জন্যে যেতে পারেন। গত ৪/৫ বছর থেকে জামারা নতুনভাবে কয়েকতলা করে পুনঃ নির্মাণ করায় পাথর নিক্ষেপে ঝুঁকি নেই বলা যাবে। অতঃপর কেরান বা তামাত্তু হাজি হলে দমে শুকরিয়া বা হজের কোরবানী করতে হবে। (ওয়াজিব) আপনি ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে থাকলে তাদের নির্ধারিত সময় মতে মাথা মুÐাবেন। আর ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে না থাকলে চলে যেতে হবে মিনার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে কোরবানীর জন্য নির্ধারিত এলাকায়। গরু বা উট কোরবানি করলে উক্ত জীব ক্রয় করে কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে হবে। তারাই জবেহের ব্যবস্থা করবে। বর্তমানে কাফেলা/এজেন্সি কোরবানীর ব্যবস্থা করছে।
কোরবানী সেরে মাথা মুÐানো বা চুল ছোট করে কেটে ফেলতে হবে। (ওয়াজিব) ঐদিন সম্ভব হলে চলে যাবেন মক্কা মোকাররমায় (ফরয) তাওয়াফের উদ্দেশ্যে। ১০ তারিখে তাওয়াফ করাটা আফজল বা উত্তম। ফরয তাওয়াফের সর্বশেষ সময় ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। আপনি হজ উপলক্ষে আগে একবার তাওয়াফ করে সায়ী (ওয়াজিব) না করে থাকলে এই ফরয তাওয়াফের পরপরই করবেন।
তাওয়াফ শেষে মিনায় চলে আসবেন। পরদিন ১১ তারিখ সূর্য পশ্চিমাকাশে প্রবেশ করলে তিন জামারায় ৭টি করে মোট ২১টি পাথর মারবেন। ১২ তারিখে ১১ তারিখের মতোই তিন জামারায় ৭টি করে ২১টি পাথর মেরে সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করবেন। ১৩ তারিখ তিন জামারায় আরো ২১টি পাথর মেরে মিনা ত্যাগ করা সুন্নাত। ১২ তারিখ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়লেই পাথর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করা রেওয়াজ বা প্রচলন হয়ে গেছে।
মক্কা মোকাররমায় ফিরে আসার পর বাকি থাকে হজের (ওয়াজিব) বিদায়ী তাওয়াফ। এ তাওয়াফ মক্কা মোকাররমা ত্যাগের প্রাক্কালে সুযোগমত করে নিতে হবে। হজের আগে মদীনা শরীফ না গিয়ে থাকলে পরে যাবেন। সম্ভব হলে ৮ দিন সেখানে থেকে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নববীতে পড়বেন। যতবার সম্ভব নবীজির রওজা শরীফ জিয়ারত করবেন।
বিশ্বের বিভিন্ন হজযাত্রীগণসহ বাংলাদেশী হজযাত্রীগণকে প্রথমে মীকাত তারপর হুদুদে হারাম অতিক্রম করে হারাম এলাকা তথা মক্কা মোকাররমায় পৌঁছতে হবে। অতএব, মীকাত অতিক্রম করার আগে এহরাম পরা বাধ্যতামূলক। মীকাতের বাহির থেকে যে কোন ব্যক্তি হজ, ওমরা বা ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি ইত্যাদি যে কোন প্রয়োজনের তাগিদে মক্কা মোকাররমা পৌঁছতে হয় তবে তাকে মীকাত অতিক্রম করার আগে এহরাম পরতে হবে। পবিত্র খানায়ে কাবার রয়েছে একাধিক মর্যাদাপূর্ণ পরিমÐলীয় স্তর। প্রথম কাবা শরীফ যা কালো গিলাপ দ্বারা আচ্ছাদিত। তার উত্তর পার্শ্বস্থ সংলগ্ন রয়েছে অর্ধ গোলাকৃতির কাবা শরীফের অংশ হাতিম। তারপর হল মাতাফ। বায়তুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকস্থ তাওয়াফের স্থানকে মাতাফ বলে যার উপর সাদা মর্মর পাথর বসানো রয়েছে। এ পাথর প্রখর রৌদ্রেও গরম হয় না। তারপর মসজিদে হারাম : চতুর্থ তলাবিশিষ্ট কাবা শরীফের চতুষ্পার্শ্বে গোলাকৃতির বিশাল এলাকা নিয়ে দালানকে মসজিদে হারম বলে। যেখানে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ লোক কাবা শরীফের দিকে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন।
মূল হারাম : মক্কা মোকাররমার চারদিকের নির্দিষ্ট সীমারেখার ভিতরের এরিয়াকে হারাম বলা হয়ে থাকে। হযরত জিবরাঈল (আ.) হযরত ইব্রাহীম (আ.) ঐ স্থানসমূহের অবগত এবং সাথে সাথে পরিচয় করিয়ে সীমানা চিহ্নিত করিয়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর হযরত রাসূলে করিম (স.) এই চিহ্নসমূহ নির্মাণ করেন। পরে আমিরুল মোমেনিন হযরত ওমর (রা.)-এর খেলাফত আমলসহ পরবর্তী সময়ে এসব সীমানা চিহ্নগুলো পুনঃনির্মাণ করেন। বর্তমানে সউদী সরকার খুবই সুন্দর করে হারামের সীমানাসমূহকে পুনঃনির্মাণ করেন। হারামের সীমা হল কাবা শরীফ থেকে জেদ্দার দিকে দশ মাইল। যেখানে সুমাশিয়াহ (হুদাইবিয়ার সন্ধির স্থান)-এর সন্নিকটে হারামের চিহ্নস্বরূপ মিনার নির্মিত রয়েছে। কাবা শরীফ থেকে মদিনা মুনাওয়ারার দিকে ৪ মাইল দূরে তানঈম নামক স্থানে। কাবা শরীফ থেকে ইয়ামানের দিকে ৭ মাইল দূর ইযাআতে লবণ নামক স্থানে। ইরাকের দিকে ৭ মাইল, জাবানার দিকে ৯ মাইল, তায়েফের দিকে আরাফাতের কাছাকাছি ৭ মাইল পর্যন্ত হারমের সীমানা।
মক্কা মোকাররমা শহর তথা এসব সীমারেখার ভিতর অর্থাৎ হারামের সীমানার ভিতর কোন স্থলজ প্রাণী শিকার বা হত্যা করা, ধরা, তাড়ানো, বৃক্ষ লতাদি অথবা ঘাস কর্তন ইত্যাদি হারাম। হজ বা ওমরাকারী বা অন্য যে কোন প্রয়োজনের তাগিদে হারামের সীমানার ভিতর প্রবেশ করতে হলে মনে রাখতে হবে এখন আপনি আহকামুল হাকেমীনের দরবারের খাস পরিধির মধ্যে প্রবেশ করছেন। এ সময় আদব বিনয় পবিত্রতা সবকিছু বজায় রাখতে ও থাকতে হবে।
এ কথা সত্য যে, মানুষ যদি নিজের মাথার উপর ভর দিয়েও এ পবিত্র হারাম এরিয়ায় চলাফেরা করে তবুও আদবের হক আদায় করতে সক্ষম হবার নয়। কাজেই যতদূর সম্ভব এ পবিত্র ভূমি হারামের মর্যাদার প্রতি হজ ও ওমরাকারীগণের সচেষ্ট থাকা চাই। আদব দেওয়া যখন কঠিন তথা সম্ভবের বাইরে অন্তত বেয়াদবী যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা অত্যাবশ্যক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন