শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নমিনেশন বাণিজ্য রাজনীতির প্রতিই অনাস্থা ডেকে আনে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

‘বাণিজ্য’ পৃথিবীর একটি আদি পেশা। বাণিজ্যের কারণেই পৃথিবীতে ইতোপূর্বে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র দখল করে নিয়েছে। তবে এখন বাণিজ্যের কারণে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে দখল করার পরিবর্তে পণ্যের বাজার অর্থাৎ অর্থনৈতিক বাজার দখল করে নিচ্ছে। এ বাজার দখল করতে বৈধ-অবৈধ পণ্যের কোনো তফাৎ নাই। বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলি নিজেরাও অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় জড়িত এবং এ জন্য তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। সম্প্রতিকালে বাণিজ্যের সাথে কিছু শব্দ যোগ হয়েছে। যেমন- সরকারি দলের টেন্ডারবাণিজ্য, আমলাদের ঘুষবাণিজ্য, রাজনীতিবিদদের কমিটি বাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত হয়েছে নমিনেশন বাণিজ্যও, যা স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুরু হলেও এখন প্রকট আকার ধারণ করে চায়ের দোকানে আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে তিনটি শব্দ খুবই জোরেসোরে প্রবেশ করেছে। যথা: (১) সুবিধাবাদী, (২) সুবিধাভোগী ও (৩) সুযোগসন্ধানী। এই তিনটি শ্রেণি ‘মালাই’ খাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধহস্ত, যাতে তৃণমূল এখন হতাশায় নিমজ্জিত। ফলে শত চেষ্টা করেও আন্দোলনের জন্য মাঠ গরম হচ্ছে না। প্রবাদ রয়েছে যে, একটি রাজনৈতিক দলের ‘মালাই’ খাওয়ার ‘মজনু’ এবং ‘রক্ত’ দেয়ার ‘মজনু’ এক নয় (মজনু বলতে এখানে দল প্রেমিককে বুঝানো হয়েছে)। অর্থাৎ একশ্রেণির রাজনীতিক রয়েছে যারা সুসময়ে দলের সম্মুখ ভাগে থাকে, অন্য এক শ্রেণি রয়েছে যারা দলের দুঃসময়ে দলকে আষ্টেপিষ্টে বুকে ধারণ করে দলের জন্য যে কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করে। কিন্তু কৌশলগত কারণে তৃণমূল হারিয়ে যায় অতল গহব্বরে, যার জন্য ঘুরে ফিরে বাণিজ্যের কথাটিই উঠে আসে। বাণিজ্যের বিষয়টি হতে পারে প্রচার বা অপপ্রচার, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে জনগণ যা বিশ্বাস করে তাই সত্যে পরিণত হয় এবং জনগণের মনের ভিতরে জন্ম নেয়া বিশ্বাস থেকেই রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতের যা ঘটে তা অনেকাংশেই প্রচার বা অপপ্রচার যাই হোক না কেন, প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনেই কিছু না কিছু রহস্য প্রকাশিত হয়, যা থেকে জনগণকে সরানো যায় না।
সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী এবং সুযোগসন্ধানী চক্র সব সময়ই ওঁৎ পেতে থাকে ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য। কোনো কমিটি গঠন বা নির্বাচনের নমিনেশনের সময় তাদের সাজ সাজ রবে দেখা যায়। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের টিকিটিও দেখা যায় না। অথচ কোনো না কোনো কারণে মূল্যায়নের প্রশ্নে রাজপথের নেতাকর্মীদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদী চক্র এবং এতে শীর্ষ নেতাদের আসকারা থাকে। এটাই জাতীয় রাজনীতির ট্রাজেডি।
সরকারি দলসহ সকলেই এখন স্বীকার করে যে, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন হওয়া দরকার। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ইতোপূর্বে বলেই ফেলেছেন যে, ‘কাউয়ার’ জন্য পার্টি অফিসে যাওয়া যায় না। সরকারি দলে কাউয়ার অভাব হয় না, কারণ সেখানে হালুয়া-রুটির খনি রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলে কমিটি ও নমিনেশনের জন্য কেন এতো পাগলপরা? এর পিছনের কারণ হলো, ‘যদি লাইগা যায়’। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে তো অনেকেই নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের সন্ধানে থাকে। এদের দ্বারা আসলে রাজনীতি হয় না। রাজনীতির অপর নাম আন্দোলন-সংগ্রাম। অথচ কমিটি ও নমিনেশন শিকারের জন্য তারা যত ব্যতিব্যস্ত থাকে, দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে তত তৎপরতা তো থাকেই না, বরং সরকারি দলের সঙ্গে অনেকের আঁতাতের অভিযোগও শোনা যায়।
সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী বা নমিনেশন শিকারীদের প্রশ্রয় দেয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলিও দায়ী। এ ক্ষেত্রে নমিনেশন শিকারীরা যেমন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দলগুলিও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ধার ধারে না। অন্য দল থেকে আগের দিন দলে যোগদান করে পরের দিন নমিনেশন, এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল নয়। তারা নমিনেশন না পেলে হয় পদত্যাগ, নতুবা ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। এ অবস্থায় যখন জাতীয় রাজনীতি চলে সেখানে তৃণমূলে হতাশা জন্ম দেয় এবং এ হত্যাশা একটি দলকে কোথায় নিয়ে যায়, তা বিরোধী দলে এসে ভুক্তভোগী দলই অনুধাবন করতে পারে।
একটি রাজনৈতিক দলের ফাউন্ডেশন হচ্ছে তার নীতি ও আদর্শ, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। সাধারণ সদস্য থেকে নীতি নির্ধারক পর্যন্ত স্বচ্ছ অনুশীলনের মাধ্যমে সেই নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তবে এ অনুশীলন নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে শুরু করলে তৃণমূলে স্বাভাবিক গতিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়, নতুবা জাতীয় নেতৃবৃন্দের মঞ্চের বক্তৃতা ও ব্যক্তিচরিত্রে যখন মিল থাকে না তখনই দেখা দেয় মনস্তাত্বিক কমিনিকিউশন গ্যাপ (গবহঃধষ ঈড়সসঁরপধঃরড়হ এধঢ়)। ফলে এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হয় যে, নেতারা গলা ফাটিয়ে ডাক দিলেও কর্মীরা রাজপথের আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়। একটি দলের নীতি ও আদর্শ কর্মীদের মন, মগজ ও রক্তে মিশিয়ে দিতে হয়। অথচ দেখা গেছে, ৬ দফা বা ১৯ দফা কী, বলতে পারে না এমন লোকও সংশ্লিষ্ট দলের এমপি বা মন্ত্রী হয়েছে। একটি দল সময়ে সময়ে ক্র্যাক ডাউন হওয়ার এটাও অনেক কারণের একটি।
একটি দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন চাটুকারের অভাব হয় না, বুদ্ধিজীবীরা রং পাল্টিয়ে আজব আজব কথা বলতে শুরু করে, দলীয় প্রধানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে এবং বিভিন্ন কারণে দলীয় রাজনীতির পরিবর্তে প্রশাসনিক কাঠামোভিত্তিক কর্মকান্ডই বেশি হয়ে থাকে। দল তখন কর্মীনির্ভর না হয়ে প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়ে। কিন্তু বিরোধী দলে থাকাবস্থায়ই দল গুছানোসহ দলকে নীতি-আদর্শভিত্তিকভাবে গড়ে তোলার উৎকৃষ্ট সময়।
একটি রাষ্ট্রকে যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে তার সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে হবে, যারা হবে ঈমানদার এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাবে না। আন্দোলনে যাওয়ার পূর্বে একটি রাজনৈতিক দলকে তার কর্মীবাহিনী বাছাই করতে হবে, সে কর্মীবাহিনী হতে হবে পরীক্ষিত, যারা ময়দান থেকে পলায়ন করবে না, শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে নীতি আর্দশের প্রতি অবিচল থাকবে। অন্যদিকে পরীক্ষিত কর্মী বাছাইয়ে সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানীকে চিহ্নিত করতে না পারাটাই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের চরম ব্যর্থতা।
দলীয় নমিনেশন নির্ধারণে একটি নীতিমালা থাকা দরকার। কারা নমিনেশন চাইতে পারে বা নমিনেশন চাইতে পারে না বা নমিনেশন পাওয়ার যোগ্যতা বা মাপকাঠি কী হবে তাও নির্ধারণ হওয়া দরকার। নমিনেশন পেপার নীতিমালার ভিত্তিতে যাচাই বাছাই হওয়া দরকার। নতুবা দলের আদর্শে বিশ্বাস করে না, দলের দুঃসময়ে কোনো ভ‚মিকা নাই এমন লোকও নমিনেশনের সময় শক্তিশালী বাঘ হয়ে দাঁড়ায়। যে কেউ দলের নমিনেশনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় নমিনেশন চাওয়াকে অনেকে রেল স্টেশনে ‘বাবু একটি টিকেট’ চাওয়ার মতই মনে করে।
এক শ্রেণির রাজনীতিক রয়েছে যারা নমিনেশন পাওয়ার জন্য ভিন্ন দলের সাথে তল খাতির করে। কোরবানির হাটের মতো, এক হাটে বিক্রি না হলে অন্য হাটে তো বিক্রি হবেই, টার্গেট শুধু ভালো মূল্য পাওয়া অর্থাৎ নমিনেশনই মূল লক্ষ্য। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে সংগঠনেও তদবির বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। ঝুঁকি নিতে পারে, দৃঢ় চিত্তে রাজনীতিকে ধারণ করতে পারে, এমন কর্মীকে সাংগঠনিক কাঠামোতে যথাযথ দায়িত্ব অর্পণ করলে দলীয় রাজনীতি জনগণের কাছে মূল্যায়িত হবে এবং রেজাল্ট জমা হবে দলের একাউন্টে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন