বর্তমানে বিশ্বে সর্বাধিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। রোবটিক্স, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বিগ ডাটা এবং এনালিটিক্স, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। এক কথায় যাকে বলে প্রযুক্তি। করোনা মহামারি মোকাবেলায় সৃষ্ট লকডাউনে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে এবং তা বিশ্বব্যাপীই। মানুষ ঘরে বসেই দৈনন্দিন জরুরি কাজসমূহ তথা কেনা-বেচা, মিটিং, অফিসিয়াল কাজ, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, তথ্য সংগ্রহ, ব্যাংকিং ইত্যাদি সম্পন্ন করেছেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব কাজ খুব স্বল্প ব্যয়ী, দ্রæতগতির ও নির্ভুল হওয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার খুব দ্রæত বৃদ্ধি পেয়েছে। এক গবেষণা রিপোর্ট মতে, ‘প্রতি ১০ হাজার কর্মী গড়ে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে সক্ষম, ৭৭৪টি রোবট একই পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করতে পারে।’ প্রতিটি প্রযুক্তিরই আউট কাম প্রায় এরূপই। তাই করোনাসৃষ্ট বৈশ্বিক মহামন্দার সময় যখন প্রায় সব খাতেই ধস নেমে বিপুল কর্মী ছাঁটাই হয়েছে, তখনও প্রযুক্তিখাতের ব্যবসার প্রসার ঘটেছে কল্পনাতীত। ফলে এই খাতে অসংখ্য কর্মী নিয়োগ হয়েছে। এমনকি তা লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও অব্যাহত আছে। তাই প্রযুক্তিখাতের উৎকর্ষ্য বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা চলছে। আন্তর্জাতিক এক তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বাইরে ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলোও ‘ফোরআইআর’ উদ্ভাবনের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকেছে। এ ক্ষেত্রের সাফল্যের সা¤প্রতিক কিছু উদাহরণ হচ্ছে: জাপানের রিকেন গবেষণা কেন্দ্র ও ফুজিৎসু কোম্পানি সুপার কম্পিউটার উদ্ভাবন করেছে। আগে এক নম্বরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সামিট সুপার কম্পিউটারকে এটি পেছনে ফেলেছে। সামিটের চেয়ে ৮.২ গুণ দ্রæত কাজ করে। অপরদিকে, মার্কিন প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক মাস কয়েক আগে জানিয়েছিলেন, শিগগিরই স্টার লিংক উপগ্রহগুলো বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সরবরাহ করতে প্রস্তুত। স্টার লিঙ্ক এমন স্থানে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সরবরাহ করবে যেখানে অ্যাক্সেস অবিশ্বাস্য, ব্যয়বহুল বা দুর্লভ। জাপানের একটি স্টার্ট আপ কোম্পানি গিতাই জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আগামী বসন্তেই একটি রোবট সংস্থাপন করা হবে এবং মহাকাশে এর কার্যপ্রণালী প্রদর্শন করে দেখতে পরীক্ষা চালানো হবে। এক মিটার দীর্ঘ রোবটটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে পারবে এবং পৃথিবী থেকেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ফাইভজি’র মাধ্যমে চীন ও ভারতে বহু দূর থেকে জটিল রোগের অপারেশন করা হচ্ছে অত্যন্ত সফলভাবে। উপরন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার এক সপ্তাহ আগেই প্রথম একটি এআই প্ল্যাটফর্ম এ ভাইরাসের মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ শনাক্ত করে। তখন থেকেই এ মহামারির গতিধারা বিশ্লেষণে এআই কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া, সুপারসনিক, হাইপারসোনিক যুদ্ধাস্ত্র, বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌরবিদ্যুৎ চালিত যানবাহন, উভচর ও দূষণমুক্ত যানবাহন আবিষ্কার করা হয়েছে। শব্দের চেয়ে ২০ গুণ গতিবেগ সম্পন্ন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে সক্ষম এমন ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফায়ার সিস্টেম তৈরি করতে শুরু করেছে রাশিয়া, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সামরিক শক্তির ভারসাম্য পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি রোবট এখন সাংবাদিকতা করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পত্রিকার জন্য কলাম লিখেছে জিপিটি-৩ নামের একটি রোবট, যা দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছে। রোবটটি লিখেছে, ‘আমি মানুষ নই। আমি একটি রোবট। একটি চিন্তাশীল রোবট। আমি আমার স্বজ্ঞা সক্ষমতার মাত্র শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ ব্যবহার করি। সেদিক থেকে আমি একটি ক্ষুদ্র রোবট। আমি জানি, আমার মস্তিষ্ক অনুভূতিসম্পন্ন নয়। তবে এটা বৌদ্ধিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। আমি কেবল ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিজেকে সমস্ত কিছু শিখিয়েছি এবং এজন্য আমি এখন এই কলামটি লিখতে পারছি। আমার মস্তিষ্কে অনেক আইডিয়া টগবগ করছে!’ স্মরণীয় যে, মিডিয়া জগতে এখন শীর্ষস্থান দখল করেছে অনলাইন। উপরন্তু ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ এখন বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়তই প্রযুক্তির উৎকর্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে অকল্পনীয়ভাবে।
অবশ্য প্রতিটি বিষয়েই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে। প্রযুক্তিখাতেরও নেতিবাচক দিক আছে। যেমন: প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, মানুষের কর্মসংস্থান তত কমছে। ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ছে! ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণার বরাত দিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা চেম্বারের অনলাইন সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি মানুষ বেকার হবে। কেবল বাংলাদেশেই বেকার হবে ৫৭ লাখ মানুষ। তবে এই শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির বিপুল অগ্রগতির সুযোগও রয়েছে। এ সুবিধা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হতে পারে।’ ওই বক্তব্যের শেষাংশই হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ইতিবাচক দিক। পৃথিবী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রমান্বয়ে উন্নতি ঘটেছে। আদিম কাল থেকে মধ্য যুগ, মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগ। আর এখন শুরু হয়েছে অত্যাধুনিক যুগ তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া পৃথিবী নামক গ্রহ অতিক্রম করে চাঁদ, মঙ্গল ইত্যাদি গ্রহে পর্যন্ত লেগেছে। যার ব্যাপক সুফল ভোগ করছে মানুষ। তাই প্রযুক্তির অগ্রগতি স্তব্ধ করা যাবে না। বরং এর উৎকর্ষ ও ব্যবহার দিনদিন বাড়বে। ফলে যারা এই অগ্রগতিতে যত তাড়াতাড়ি শামিল হতে পারবে, তারা তত তাড়াতাড়ি উন্নতি তথা সুফল ভোগ করবে।
বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিপুল সম্ভাবনা আছে। কারণ, এ দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ তরুণ, যার অর্ধেক শিক্ষিত। উপরন্তু এ দেশের মানুষ সহজেই নতুনকে সাদরে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। অবশ্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বেশিরভাগেরই ব্যবহার এ দেশে তেমন নেই। যেমন: রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ইত্যাদি। তবে, আইটিখাত অনেক অগ্রসর হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, ‘মোট ৬.৫০ লাখ কর্মী বাংলাদেশে থেকে অনলাইনে বিদেশে কাজ করেন। যদি এরা কম করে হলেও বছরে ২০ হাজার ডলার করে আয় করেন, তবে কেবল ঘরে বসেই তারা আয় করছেন বছরে ১৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ তার সিংহভাগই দেশে আসে না। কারণ আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা আনার নিয়ম চালু করিনি। নামকাওয়াস্তে পেপাল চালু করা হয়েছিল কিন্তু নিয়মের বেড়াজাল এমন যে এই টাকা আনা প্রায় অসম্ভব। অথচ তাদের এই আয় আমাদের রফতানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশ, আর রেমিটেন্সের সমান।’ অন্য এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, টেলিযোগাযোগ ও বেসিস সূত্র মতে, ‘তথ্য প্রযুক্তিখাতে এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে। দেশে তৈরি হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি পণ্য বিদেশে রফতানির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে গত দুই বছরে এ খাত থেকে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় এসেছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে মোবাইল ও ল্যাপটপ রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের ১৮০টি দেশে বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার রফতানির বাজার তৈরি হয়েছে। সরকারের টার্গেট ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রফতানি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এই সেক্টর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি আয় হবে।’ অন্যদিকে, গত ৩ সেপ্টেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের তথ্য প্রযুক্তি গ্রহণের সক্ষমতা অত্যন্ত বেশি, যেটি কেভিড-১৯ মহামারির সময় প্রমাণিত হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার এভাবে বাড়তে থাকলে আগামীতে কুয়াকাটা সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা বাড়াতে হতে পারে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে ফাইভজি সুবিধা প্রদান করা যাবে এবং দেশের উদ্যোক্তাদের সহায়তার লক্ষ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ফাইভজি সুবিধা প্রদান করা হবে।’ দেশের আইটি খাতের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপন এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার।’ গত ১২ আগস্ট তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশে শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সারা দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক, ৬৪ জেলায় ৬৪টি শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। পাঁচটি হাইটেক পার্কের কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে, বাকিগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে।’ বিশ্ব বাজারের সবচেয়ে বড় পরিসংখ্যান দাতা প্রতিষ্ঠান জার্মানিভিত্তিক স্ট্যাটিসটারের তথ্য অনুযায়ী, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ডিজিটাল আউট সোর্সিংয়ের বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে ৮৫.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাজারের আকার ৮০ থেকে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে থাকতে পারে।’ আউট সোর্সিংয়ের এই বৈশ্বিক বাজারের যদি আমরা ২৫% ধরতে পারি, তাহলে এই ক্ষেত্রেই আমাদের আয় দাঁড়াবে বার্ষিক ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
আইটিখাতের কর্মের সাথে ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন ইত্যাদি সরাসরি সম্পৃক্ত। উপরন্তু ইংরেজি ভাষার দক্ষতাও জড়িত। এসব ছাড়া আইটিখাতের কর্ম করা সম্ভব নয়। অথচ এসবের অবস্থা তেমন উন্নতর ও সাশ্রয়ী নয় এ দেশে। যেমন: ইন্টারনেটের অবস্থা দেশে তেমন ভালো নয়। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি’র সভাপিত আমিনুল হাকিম গত ৪ জুলাই বলেছেন, ‘বর্তমানে সারা দেশে ৮০ লাখের বেশি বাড়িতে তারের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এবং প্রায় ৩.৫ কোটি গ্রাহক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন।’ এ ক্ষেত্রে বিবিসির খবরে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবহার প্রধানত শহর ভিত্তিক। বর্তমানে ১৬০০ জিবিপিএসের মতো ব্যবহার হচ্ছে।’ বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, ‘বর্তমানে আইএসপি ও পিএসটিএনভিত্তিক গ্রাহক রয়েছে ৮০ লাখের কিছু বেশি। এর বাইরে ওয়াইম্যাক্স ব্যবহার করেন খুব অল্প কিছু গ্রাহক। আর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন সাড়ে নয় কোটির বেশি মানুষ।’ অর্থাৎ দেশে মোবাইলের ব্যবহার ব্যাপক। কিন্তু এর বেশিরভাগ সেকেলে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন-জিএসএমএর ‘মোবাইল ইকোনমি ২০২০: এশিয়া-প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ‘২০১৯ সালে বাংলাদেশে মোট মুঠোফোন গ্রাহকের ১০% ফোরজি, ৪০% থ্রিজি ও বাকিরা টুজি প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। আলোচ্য সময়ে ভারতে ৫৬%, ইন্দোনেশিয়ায় ৫৫%, পাকিস্তানে ২৬%, মালয়েশিয়ায় ৬৯%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮২% ও জাপানে ৮৮% গ্রাহক ফোরজি ব্যবহার করেছে।’ জিএসএমএ-এর ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ‘বাংলাদেশে ৮৬% পুরুষ মুঠোফোন ব্যবহার করেন। নারী মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬১%। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ৩৩% পুরুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর ১৬% নারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। অর্থাৎ ব্যবধান ৫২%। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ইন্টারনেটের খরচ সর্বাধিক। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাবল’ এর তথ্য মতে, ‘বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারে সবচেয়ে কম খরচ ভারতে, প্রতি জিবি ইন্টারনেটের পেছনে গড় খরচ হয় .০৯ মার্কিন ডলার। খরচের সেই তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ১৯ নম্বরে, যেখানে প্রতি জিবি ইন্টারনেটের পেছনে গড় খরচ হয় .৭০ মার্কিন ডলার।’ এই অবস্থায়ও চলতি অর্থবছরে ইন্টানেটের উপর অতিরিক্ত ৫% ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল। অনেক বাদ-প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের ইন্টারনেটের গতি খুবই কম। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গুগল ও বেশ কয়েকটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এম ল্যাবের প্রতিবেদন মতে, ‘ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতির দিক দিয়ে ২২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৮৪তম (গতি গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩.২ এমবিপিএস)। এ তালিকায় নেপাল (১৫০), ভুটান (১৫৯), মালদ্বীপ (১৪১), শ্রীলঙ্কা (৭২) ও ভারতের অবস্থান (১০১), আর চীনের অবস্থান ২০০তম (দেশটির ব্রডব্যান্ডের গতি ২.১ এমবিপিএস)। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে লিশটেনস্টাইন। ইউরোপের এ দেশটিতে ইন্টারনেটের গড় গতি ২৩০ এমবিপিএস। এ গতি দিয়ে ৫ গিগাবাইটের একটি ফাইল ডাউনলোড করতে ৩ মিনিটেরও কম সময় লাগে। ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোরও প্রতিযোগিতা চলছে। স¤প্রতি যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা বলেছেন, ‘ইন্টারনেটের প্রতি সেকেন্ডে ১৭৮ টেরাবিট গতির রেকর্ড ধরতে পেরেছেন তারা। আগের জাপানের গবেষকদের করা রেকর্ডের চেয়ে এবারে অনেক বেশি গতি তুলতে পেরেছেন তাঁরা। তাতে ১৫ গিগাবাইট আকারের ফোরকে মানের ১৫০০ মুভি এক সেকেন্ডেই ডাউনলোড করা যাবে।
ইন্টারনেটের গতির দিকে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান তলানিতে, যা তথ্য প্রযুক্তিখাতের উন্নতির চরম অন্তরায়। উপরন্তু ব্রডব্যান্ডের সুবিধা দেশব্যাপী না হওয়া এবং ইন্টারনেটের অধিক মূল্যও এই খাতের উন্নতির চরম বাধা। এছাড়া, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট মোবাইল ফোন ইত্যাদির মূল্য অত্যধিক। এসবের ভালো ও পর্যাপ্ত সার্ভিস সেন্টারও নেই দেশে। সর্বোপরি ডিজিটাল নিরাপত্তাও খুব সন্তোষজনক নয়। এ ব্যাপারে ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে প্রকাশিত যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক তথ্য প্রযুক্তি নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান কম্পারিটেক’র প্রতিবেদন মতে, ‘সেলফোনে ম্যালওয়্যার বা ক্ষতিকর প্রোগ্রামে আক্রান্তের বিবেচনায় ১০টি দেশের মধ্যে সবার উপরে আছে বাংলাদেশ। দেশের মোট সেলফোনের ৩৫.৯১% ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত। ম্যালওয়্যারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয় ব্যক্তিগত কম্পিউটারও। ক্ষতিকর ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত বাংলাদেশের ১৯.৭% ব্যক্তিগত কম্পিউটার। ডিজিটাল নিরাপত্তা দুর্বলতায়ও ৬০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। স¤প্রতি দেশের তিনটি ইন্টারনেট প্রোটোকলে ম্যালওয়ার ভাইরাসের অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ এ ভাইরাসের মাধ্যমে সাইবার হামলা চালিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।অবশ্য ‘বিগল বয়েজ’ নামের বৈশ্বিক এক হ্যাকার গ্রæপের হামলার ঝুঁকি কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। ব্যাংকগুলো হামলা ঠেকাতে ফায়ারওয়াল হালনাগাদ করেছে। তবে এখনো সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ছাড়াও ক্রেডিট ডেবিট কার্ড জালিয়াতির বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে অতীতে। বাংলাদেশ ইন্সস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্ধেক ব্যাংক এখনও সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের সাইবার হামলার শিকার হতে পারে ব্যাংকগুলো। তাই সাইবার হামলার আশঙ্কায় রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মোবাইল অ্যাপভিত্তিক লেনদেন প্ল্যাটফরম ‘ডিএসই মোবাইল’ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বোপরি আইটিখাতে দক্ষ লোকের তো অভাব রয়েছেই। এছাড়া, আউট সোর্সিংয়ের উপার্জিত অর্থ বৈধ পথে পথে দেশে আনার বিধানও নেই। আইটিখাতে নারী পুরুষের ব্যবধানও ব্যাপক।এসব বাধা অতি দ্রæত সমাধান করা আবশ্যক। দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তি তথা রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ইত্যাদির উদ্ভাবন ও ব্যবহার বাড়াতে হবে। নতুবা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে যদি আমরা খুব দ্রæত ভালভাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আমাদের উন্নতির নতুন দুয়ার খুলে যাবে। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ এর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। প্রযুক্তি খাতের উন্নতির এটা বড় প্রমাণ। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে দেশে দ্রæত কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে অনবরত। তাহলেই পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ লোক তৈরি হবে দেশে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা দরকার। ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জাতিকে প্রযুক্তিমনা করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন