পুরো পৃথিবী যখন করোনায় আক্রান্ত, তখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল থাবায় মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিজ্ঞানীদের সকল প্রজেকশন দেখাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে জলবায়ু-স¤পর্কযুক্ত দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে এবং মহামারির ক্রান্তি লগ্নে করোনার সংক্রমণ এবং জনস্বাস্থ্যের রেসপন্সকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে করোনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আঘাতে অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, ব্যবসা, এবং শিক্ষাকে নজিরবিহীনভাবে ঝুঁকির মুখে নিপতিত করেরছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জনে অগ্রগতির ওপর গত ৩০ জুন একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৬৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবেদনে উল্ল্যেখ করা হয়েছে, দারিদ্র নিরসনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। তবে অতিদারিদ্র্য নিরসনে সফল হলেও দারিদ্র্য নিরসনে সফল্যের হার কম। ক্ষুধামুক্তির সূচকগুলোতে দেখা যায়, তিনটি সূচকে বাংলাদেশ ভালো করলেও দুটিতে স্থিতাবস্থায় ও দুটিতে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনায় কাবু। প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই দেশের বড় একটা অংশ দীর্ঘমেয়াদি বন্যার মুখে পড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, এসডিজি অর্জনে দেশকে হতদরিদ্রমুক্ত করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার, তা যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তবে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ও বন্যার এ পরিস্থিতিতে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন অব্যাহত রাখতে হলে কমপক্ষে এক কোটি মানুষকে ছয় মাস প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তা প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনে বাজেট পুনর্বিন্যাস করতে হবে। অর্থায়ন পুনর্বিন্যাস করে দারিদ্র্যে নিরসনের ওপর জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশে করোনাকালে বন্যা, এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা! রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পর এখন দেশের দক্ষিণাঞ্চল বন্যার পানিতে ভাসছে। আ¤পানের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখনো ভুগছে। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই চলছে। পশ্চিমবঙ্গ আ¤পানে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ বন্যা কবলিত হয়েছে। এপ্রিলে পুরো দক্ষিণ প্যাসিফিক আইল্যান্ড ক্যাটাগরি ৫ ট্রপিক্যাল সাইক্লোনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। করোনাকালে জিম্বাবুয়েতে নজীরবিহীন খরা, সোমালিয়ায় বন্যা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ভয়ানক খরা ও দাবানল, একইভাবে আমেরিকার ফ্লোরিডায় গরম চরম-মাত্রা অতিক্রম করছে। আবার গালফ কোস্টে হ্যারিক্যান আঘাত করছে। অন্যদিকে, আমেরিকার আরকান্সাস, লুসিয়ানা, ও মিসিসিপি প্রদেশ বন্যার কবলে। পৃথিবীর আরও অনেক দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
মানুষ প্রকৃতির অংশ। অথচ মানুষ যে হারে প্রকৃতিকে করায়ত্ত করার চেষ্টা করেছে তা অচিন্তনীয়। করোনা ভাইরাসকে অনেকে বলছেন ‘প্রকৃতির সমুচিত জবাব’, যার জন্য মানুষই দায়ী। কারণ, মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণীজগতকে শোষণ করছে। করোনা ভাইরাসের টিকা আজ না হয় কাল আসবেই, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন রক্ষার্থে কোন টিকা নেই। তাই জলবায়ু নিয়ে আমাদেরকে ভাবতেই হবে, বিশেষকরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা, সাইক্লোন, এবং হিট-ওয়েভ, মোকাবেলায় প্রধানত স্ট্রাকচারাল এবং নন-স্ট্রাকচারাল (উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, জমি ব্যবহারের পরিকল্পনা, বন্যা মনিটরিং ও জনগণকে সজাগকরণ) পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা বা কমানোর জন্য প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের প্রয়োগ বাড়াতে, যদিও এই সমাধানগুলোর ধারনা অপেক্ষাকৃত নতুন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কন্সারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) জোরেশোরে বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাকৃতিক সমাধান খোঁজার দিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যাবশ্যক। একইভাবে বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০ ও প্রকৃতিভিত্তিক সল্যুশনের কথা হালকাভাবে বলছে।
প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান বলতে সাধারণত প্রকৃতি বা বাস্তুসংস্থান (ইকোসিস্টেম) কে ব্যবহার করে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদী, খাল ও বিল সচল রাখা এবং সাইক্লোন প্রতিরোধে বনাঞ্চল (যেমন সুন্দরবন) রক্ষা ও বাড়ানো। প্রকৃতি-ভিত্তিক, গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বা নেচার- বেইসড সল্যুশনের সামাজিক (জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন), অর্থনৈতিক (ট্যুরিজম ও এনার্জি সেভিংস) ও পরিবেশগত (কার্বন স্টোরেজ ও হিট রিডাকশন) উপকারিতা বিশাল। এছাড়া এইসব সল্যুশনের কো- বেনেফিট (সহ-উপকারিতা) বিরাট, যা ক্লাইমেট অ্যাকশন এজেন্ডাকে (অভিযোজন ও প্রশমিতকরণ) অন্তর্ভুক্ত করে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকি কমায় এবং জীব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ বাড়ায়। আবার নেচার- বেইসড সমাধানগুলো বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ রোধ করে। বাংলাদেশের মত গরিব দেশে এইসব স্ট্র্যাটেজি বেশি দরকার। কারণ, আমাদের গ্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ইনভেস্ট করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাড়াছা জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রাক্কালে গ্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচার দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরোপুরি মোকাবেলা করা যাবে না, তা প্রমাণিত।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক দেখিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা বা কমানোর জন্য পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের উপর ইনভেস্টমেন্ট বেড়েই চলছে। ২০১২-২০১৮ অর্থ বছরে বন্যা ও বন্যার প্রভাব কমানোর জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নেচার-বেইসড সমাধানের উপর ১.২ ইউএস বিলিয়ন ইনভেস্ট করেছে (৩৪ প্রজেক্টে)। টাইফুন হাইয়ানের পর ফিলিপিন্স সরকার ম্যানগ্রোভ ও প্রাকৃতিক বীচ বন সংরক্ষণে ২২ মিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০১১ সালের ভয়াল ভ‚মিক¤প ও সুনামির পর জাপান সরকার উপক‚লবর্তী বন স¤প্রসারনে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন ব্যয় করেছে। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের হিসাব মতে ভিয়েতনাম উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টেও পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছে, যা প্রায় ২১৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার রক্ষা করবে। সারফেস ফ্লাডিং নিয়ন্ত্রণে আরবান ডিজাইনে গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে প্রাধান্য দিয়ে চীন ৩০ টি ¯পঞ্জ সিটি তৈরিতে বিশাল অংকের বিনিয়োগ করছে। শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণে জার্মানিও চায়নার পথে হাঁটছে। আমাদের দেশের সঙ্গে খাপ খায় এমন প্রকৃতি-ভিত্তিক সল্যুশনের দিকে আরও বেশি বেশি বিনিয়োগ করা উচিৎ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, নদীর নাব্যতা বাড়ানো। নদীর গতিপথ পরিষ্কারের জন্য উন্নত প্রযুক্তিতে ড্রেজিং করে নদীর গতিপথে জমে থাকা পলি অপসারণ করে নদীর নাব্য ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে দরকার। নদীর নাব্য বাড়ানো কোথায় হবে ও কিভাবে হবে তা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করতে হবে। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মধ্যে সমন্বয় অত্যাবশ্যক। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গভীরতা বাড়ানোর জন্য নদীর প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে।
বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি, তার সমাধানে সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপ দরকার। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী, খাল, বিল, হাওড়, ও অন্যান্য জলাভ‚মি দখলমুক্ত করা ছাড়া বিকল্প নেই। শহরের আশেপাশে জলাভ‚মি ভরাট করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রোধ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ অনেক জেলা শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে অসম্ভব। শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে এলাকাভিত্তিক সমাধান না খুঁজে পুরো নগরী এবং আশপাশের এলাকার জন্য পরিকল্পনা, সঠিক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। মোট কথা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, সমাধান খুঁজতে হবে ব্যবস্থাপনায়।
করোনাকালে দেশের মধ্য ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছে। বহুমানুষ গরীব হয়ে গেছে। আয় কমে গেলেও ব্যয়ের পরিমাণ একই রয়ে গেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ ও শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যকে। চলমান বন্যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবছর বন্যা জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বলতে গেলে, এসবের সাথেই আমাদের বসবাস। তাই বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাস মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কর্মপন্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। বন্যাকালীন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য অপ্রতুল। বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা না গেলে গ্রামীণ জনপদের অর্থনৈতিক সংকট আরো তীব্রতর হবে।
টেকসই দুর্যোগ মোকাবেলা অনেকটাই নির্ভর করছে আমরা কতটা জোর দিচ্ছি প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের উপর। আইপিসিসি’র পঞ্চম অ্যাসেসমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সফল না হলে নিরাপদ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং সহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন