গতকাল বৃহস্পতিবার একটি সহযোগী ইংরেজি দৈনিকে একটি উদ্বেগজনক খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঐ খবরে দেখা যায়, মাত্র দু’বছরে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪ সালে যেসব বাংলাদেশী ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন তাদের সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৮ হাজার। উল্লেখ করা যেতে পারে, এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালে এই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিলো ৭ হাজার। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টারের’ সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়। ঐ রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইউরোপে যেসব নাগরিক রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশীদের স্থান ১৪তম। পিউ গবেষণা কেন্দ্রের রিপোর্টে অবশ্য ৩০টি দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রয়েছে ২৮টি দেশ এবং এর বাইরে রয়েছে আরো দুটি দেশ। এই দুটি দেশ হলো নরওয়ে এবং সুইডেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের (এ্যাসাইলাম প্রার্থী) ব্যাপারে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আশ্রয় প্রার্থীদের মধ্যে চারভাগের তিনভাগ অর্থাৎ ৭৩ শতাংশই হলো যুবক। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ এর মধ্যে। অথচ যেসব দেশ থেকে বেশী সংখ্যক তরুণ ও যুবকদের আশ্রয় প্রার্থনার কথা, সেই সব দেশ অর্থাৎ ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে আগত রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী তথা শরনার্থীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম, অর্থাৎ ৫৩ শতাংশ। আরো একটি অবাক করার বিষয় হলো, অন্যান্য দেশের এ্যাসাইলাম প্রার্থীদের মধ্যে যেখানে ৭৩ শতাংশ পুরুষ সেখানে বাংলাদেশের এ্যাসাইলাম প্রার্থীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা হলো ৯৫ শতাংশ। তরুণী এবং শিশুদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় এটা বোঝা যায়, আশ্রয় প্রার্থীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সপরিবারে দেশ ছাড়েনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা একা একাই দেশ ছেড়েছে। হয়তো তারা ভেবেছে যে, রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার পর তারা পরিবার নিয়ে আসবে। এই বিষয়টি বিশেষ করে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ, তাদের মধ্যে তিন চতুর্থাংশই হলো পুরুষ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ এর মধ্যে। তবে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ২০১৫ সালে যেসব পাকিস্তানী রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছে তাদের সংখ্যা হলো ৪৭ হাজার। পক্ষান্তরে বাংলাদেশীদের সংখ্যা হলো ১৮ হাজার।
বাংলাদেশ থেকে কেন এতো বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছে, সেটি পিউ গবেষণা কেন্দ্রের রিপোর্টে বলা হয়নি। তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা কেন করা হয় সে সম্পর্কে কম বেশী সকলেরই একটি ধারণা রয়েছে। এই এ্যাসাইলাম প্রার্থীদের সংখ্যা ১৮ হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ১৮ হাজার তো হলো শুধুমাত্র ইউরোপে। এখন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, প্রভৃতি দেশে এ্যাসাইলাম প্রার্থনা করছে। যত দূর জানা যায়, কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমেরিকাতেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের ভিড় ছিলো বেশী। ইউরোপে যারা এ্যাসাইলাম প্রার্থনা করছে তাদের মধ্যে কত শতাংশ শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্ব পাচ্ছেন সেটি ঐ রিপোর্টে উল্লেখ নাই। কিন্তু আমেরিকায় আশ্রয় প্রার্থীদের অধিকাংশই যে, নাগরিকত্ব পেয়েছে অথবা পেতে যাচ্ছে সেটি মোটামুটি বলা যায়। কারণ এখন এদেশের অনেক মানুষেরই ঘনিষ্ঠজন আমেরিকায় বাস করে। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্থায়ী হয়েছে নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডায়। বাংলাদেশের অনেকেই এখন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াকেও পছন্দ করছে। ইউরোপ-আমেরিকা যেখানেই হোক না কেন, এই উপমহাদেশের কোনো ব্যক্তি যখন ঐসব দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে তখন সাধারণত তাদের স্বদেশে রাজনৈতিক নিপীড়ন, জুলুম এবং নিরাপত্তাহীনতা উল্লেখ করা হয়। একথা ঠিক যে, যারাই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তাদের সকলেই যে, রাজনৈতিক জুলুম, নিপীড়ন এবং নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয় সেটি ঠিক নয়। তবে একটি দেশ সম্পর্কে বিদেশে যদি নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়, যদি ঐসব দেশে এই ধরনের একটি সাধারণ পারসেপসন থাকে যে, আশ্রয় প্রার্থীদের স্বদেশে গণতন্ত্র নাই, আছে স্বৈরাচার এবং আছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সেসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের আবেদন উদারতার সাথে বিবেচনা করা হয়। এসব কারণে বিদেশে এ্যাসাইলাম প্রার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য কোনো সম্মানজনক ব্যাপার নয়। এর ফলে দেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হয়। এ্যাসাইলাম প্রার্থনার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য থাকে। যদি সত্যি সত্যি কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা স্বদেশে বিপন্ন হয়ে থাকে তাহলে তার আশু উদ্দেশ্য হয় বিদেশে জানমালের নিরাপত্তা লাভ। আর একটি উদ্দেশ্য হয় বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। অর্থনৈতিক মন্দাসহ অনেক ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিয়ে আমেরিকা বিগত কয়েকটি বছর পার করেছে। তারপরেও এদেশের অসংখ্য মানুষের কাছে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের কাছে আমেরিকা আজও একটি স্বপ্নের দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই যে কোনো মূল্যে মানুষ আটলান্টিক পাড়ি দিতে চায়।
বিগত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে বিদেশ মুখীতার গন্তব্য বহুমুখী হয়েছে। এখন সুমেরুর দেশ নরওয়ে পর্যন্ত মানুষ ধাবমান। আশপাশের দেশ সুইডেন, ডেনমার্ক এমনকি শীত প্রধান ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও মানুষ যাচ্ছে। বিদেশে চাকরি পাওয়া বা কাজ পাওয়ার জন্য তুষার প্রধান দেশ আলাস্কাতেও মানুষ যাচ্ছে। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আলাস্কা, আইসল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের দরখাস্ত এখনো উদারভাবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে তেলে দাম মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। এমনকি সউদী আরব থেকেও এই মর্মে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, সেখানে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে নির্মাণ সংস্থার আয় কমে যাওয়ায় তারা শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এই ছাঁটাইয়ের মধ্যে কিছু কিছু বাংলাদেশীও পড়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তেমন একটি অবস্থায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীরা বোঝার ওপর শাকের আঁটি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আস্থাহীনতার সৃষ্টি। সরকার যদি এই আস্থাহীনতা দূর করতে পারে, নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার এই প্রবণতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন