শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মেডিকেল ও স্বাস্থ্যশিক্ষার মান রক্ষা করতে হবে

প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নিয়ম ও শর্ত লঙ্ঘন করে শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগে দেশের ১০টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে সর্বোচ্চ আদালত। ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম নম্বর প্রাপ্তির শর্ত পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও ১৫৩ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানোর কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না এবং জরিমানা করা হবে না এই মর্মে একটি শোকজ নোটিশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসমার্ক ধরা হয় ৪০। কিন্তু আলোচ্য ১০টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ন্যূনতম পাসমার্কের শর্ত লঙ্ঘন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর জেরে ১৫৩ জন শিক্ষার্থীর প্রথম পর্বের পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র আটকে দেয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্ত মেডিকেল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের এই রুল জারি করল। স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা সেবার মানহীনতার প্রশ্নে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা রয়েছে। এ কারণেই দেশে অনেক ভাল চিকিৎসক এবং মানসম্মত হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। এভাবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে চলে যায়। বিশেষত: মেডিকেল শিক্ষা এবং সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার যথোপযুক্ত মান উন্নয়নে সরকারী মনিটরিং অপ্রতুল। দেশীয় হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে জনগণের এই আস্থাহীনতার পেছনে যে সব কারণ রয়েছে তা খুঁজে বের করার পাশাপাশি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবী।  
মেডিকেল শিক্ষা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় মান এবং যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষীয় নজরদারির অভাবে দেশের চিকিৎসা সেবা বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ও হুমকির মুখে পড়েছে। একদিকে স্বাস্থ্যসেবা খাতের এই নৈরাজ্য দূর করার কোন সরকারী উদ্যোগ না থাকা, অন্যদিকে সরকারী হাসপাতালগুলোতে নানা ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা বিদ্যামান থাকায় বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ভুয়া ডাক্তার ও ভুল চিকিৎসায় প্রতিবছর বহু মানুষ অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, দেশে অবৈধ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৩১ হাজারের বেশী। এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কর্মরত তথাকথিত ডাক্তার ও মেডিকেল অফিসারদের প্রশিক্ষণ এবং বেসিক ডাক্তারী সনদ যাচাইয়ের কোন ব্যবস্থাই যেন কার্যকর নেই। তা না হলে প্রকাশ্যে তিরিশ হাজার অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল গড়ে ওঠা এবং বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পরিষেবার নামে ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারার এই নির্মম বাণিজ্য অব্যাহত রাখা অসম্ভব। সভ্য দুনিয়ায় আর কোন দেশে চিকিৎসা সেবার নামে এমন অবৈধ কর্মকা-ের নজির আছে কিনা আমাদের তা জানা নেই। বেসরকারী মেডিকেল কলেজ, বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশাপাশি নকল, মানহীন ও অবৈধ ওষুধ কারখানাও গড়ে উঠেছে যত্রতত্র। সম্প্রতি এ ধরনের ৪৪ ওষুধের রেজিস্ট্রেশন বাতিল এবং ২০ ওষুধ কোম্পানীর ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছে সরকার। এছাড়া ১৪টি কোম্পানীর বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরী বন্ধ করা হয়েছে। মানহীন এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এসব ওষুধ কোম্পানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত অবৈধ ওষুধ কারখানা ভেজাল, নকল ও মানহীন ওষুধ তৈরী করছে। একশ্রেণীর মানহীন ও ভুয়া ডাক্তার এসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করে রোগীদেরকে মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
যেখানে সরকারী হাসপাতালের অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও রোগীদের সাথে ভুল আচরণ ও ভুল চিকিৎসার দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে, দেশের শতাধিক মেডিকেল কলেজের মধ্যে দুইতৃতীয়াংশই (৬৪টি) বেসরকারী মেডিকেল কলেজ। এক রিপোর্টে দেখা যায়, বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে ১০-১২টি কোন রকমে মান ধরে রাখতে পারলেও বাকি সবগুলোই মানহীন। এভাবেই দেশে প্রতিবছর পাস করা ডাক্তারের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা সেবার মান বাড়ার বদলে ক্রমে নিম্নমুখী হচ্ছে। দু’বছর আগে (২০১৪ সালে) একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, পূর্ববর্তী দু’বছরে শতাধিক ভুয়া হাসপাতাল কয়েকশত ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে র‌্যাব। ভুয়া ডাক্তার ও অবৈধভাবে পরিচালনাকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলেও বৈধভাবে পরিচালিত বেসরকারী মেডিকেল কলেজের অবৈধ পন্থায় শিক্ষার্থী ভর্তি ও প্রকারান্তরে সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেই। মূলত: সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর ডাক্তারের স্বেচ্ছাচারী, অনৈতিক, বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মত বেড়ে গেছে অবৈধ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ভুয়া ডাক্তারের সংখ্যা। দেশের মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার কাক্সিক্ষত মান উন্নয়নে এ সেক্টরের পুরো কাঠামো সংস্কারের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক কারণে সরকারী হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজের একশ্রেণীর ডাক্তারের বেপরোয়া দুর্নীতি, অসদাচরণ ও অবৈধ কর্মকা-ের সুযোগ অব্যাহত রেখে শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক বেসরকারী মেডিকেলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ভুয়া ডাক্তার ও ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়া থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে হলে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানহীন মেডিকেল কলেজ পরিচালনার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। সরকারী-বেসরকারী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার মানবৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন