দেশের বিনিয়োগ, রফতানী বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতি যখন কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন, তখন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও স্বেচ্ছচারিতার চক্র থেকে বের করে বিনিয়োগবান্ধব ভূমিকা গ্রহণের তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। গত বৃহস্পতিবার বিআইবিএম-এর মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদসহ বিভিন্ন ব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান সমমস্যা এবং তা উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেন। ‘ইমপ্লিকেশন অব লোন রিসিডিউলিং অ্যান্ড রাইট অফ অন দ্য পারফরমেন্স অব ব্যাংকস’ শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। মি. এস কে সুর চৌধুরী যথাসময়ে ব্যাংক ঋণ আদায় করাকে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করলেও পাশাপাশি আকস্মকি দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে সময়মত ঋণপরিশোধে ব্যর্থ ভাল গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে সময় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বক্তারা। অর্থাৎ ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আগ্রাসী ব্যাংকিং পরিহারের উপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় নানাবিধ অনিয়ম, অদক্ষতা, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজরদারি বৃদ্ধিসহ নতুন নতুন গাইডলাইন আরোপের পরও সাম্প্রতিক সময়ে মন্দ ও খেলাফি ঋণ বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে।
চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে যখন মন্দার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে, তখন আভ্যন্তরীণ সম্পদ ও বিনিয়োগের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী। এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কোন আশাবাদ দেখা যাচ্ছে না। এক সময়ে বড় বড় ঋণ গ্রহিতাদের মধ্যে অনেকে খেলাফি হলেও এখন এসএমই ঋণেও খেলাফির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। ভাল ঋণ গ্রহিতাদের প্রয়োজনীয় সময় না দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ অথবা অবলোপনের সুযোগ দিলে প্রকৃত খেলাফি বা মন্দ গ্রাহকরাই মূলত লাভবান হয়। গত বছরের ফিনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে আগের বছরের তুলনায় পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে জানা যায়। এমনকি এসএমই খাতেও খেলাফি ঋণ বেড়ে যাওয়ার চলমান প্রবণতাকে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য একটি অশনি সংকেত হিসেবে বিবেচনা করছেন আলোচকরা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে লুটপাট-ডাকাতি থেকে শুরু করে অধিকাংশ বেসরকারী ব্যাংকের কু-ঋণ, অস্বচ্ছতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভ চুরি পর্যন্ত দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং সেক্টরে এক প্রকার বল্গাহীন অবস্থা বিরাজ করছে। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ও নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরকে এ অবস্থা থেকে বের করে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরী।
গত এপ্রিল মাসে জাতীয় প্রেসক্লাবে সুজন আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নরসহ অংশগ্রহণকারী বক্তারা সুশাসন ও স্বচ্ছতার অভাবে দেশের ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। গত ৭ বছরে ৬টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতেই ৩০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার তথ্য দিয়েছিলেন বক্তারা। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে একদিকে সাধারণ মানুষ ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি আস্থা বা আগ্রহ হারাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অনেক বিনিয়োগকারী বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং সেক্টরকে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। মন্দ গ্রাহক ও ভাল গ্রাহকদের মধ্যে পাথর্ক্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের বুঝতে হবে। যারা রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে অথবা জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্যাংকগুলোকে আর্থিক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জনবান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবী। অযাচিত নিয়ন্ত্রণ, অহেতুক খবরদারি বন্ধ করে ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রথমে এ খাতকে রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত, সৎ, সুদক্ষ প্রশাসন ও জনশক্তির উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন