বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সউদী আরবের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। সউদী সরকার গত বুধবার রিয়াদস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহকে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি অবহিত করেন। এর ফলে বিগত সাড়ে ৭ বছর ধরে অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ থাকার বিষয়টির অবসান হয়েছে। এখন সব ধরনের কাজে বাংলাদেশী দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক সউদী আরব যেতে পারবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ এই বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে জনশক্তি খাত একপ্রকার নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্রমবাজারকেও সংকুচিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া প্রায় বন্ধই করে দেয়। অবশেষে সউদী আরবের মহানুভবতায় বন্ধ দুয়ার খুলে গেল। ভ্রাতৃপ্রতিম সউদী আরবের সাথে বাংলাদেশের উত্তরোত্তর সম্পর্কের উন্নয়ন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সউদী আরব সফরের সুফলের অংশ হিসেবে এই বাধা দূর হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত জুনে সউদী বাদশা সালমানের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরে গিয়ে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা পুনরায় চালুর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়েই সউদী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতের জন্য এটি একটি সুসংবাদ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বৃহৎ মাধ্যম জনশক্তি রফতানি প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে থাকলেও দেশগুলোর সরকারের তরফ থেকে কেবল আশ্বাস ছাড়া কার্যকর তেমন কিছুই মিলছিল না। সউদী আরব মাঝে কিছু নারী গৃহকর্মী নেয়ার ঘোষণা দিলেও তা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক ও জটিলতা দেখা দেয়। আরব আমিরাত তো শ্রমিক নেয়া একেবারে বন্ধ করে দেয় এবং এখনও বন্ধ রেখেছে। সউদী আরবে সাড়ে ৭ বছর আগে যেখানে বছরে গড়ে এক লাখের মতো শ্রমিক যেত, সেখানে এ সংখ্যা গড়ে প্রায় দশ হাজারে নেমে আসে। এদের বেশিরভাগই যায় সেখানে অবস্থানরত প্রবাসীদের ব্যক্তি উদ্যোগ এবং পারিবারিক ও আত্মীয়তার সম্পর্কের সূত্র ধরে। সরকারের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আরেক বৃহৎ জনশক্তি রফতানির দেশ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার এখনো উন্মুক্ত করা যায়নি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জি টু জি বা সরকারিভাবে চুক্তি সম্পাদিত হলেও এবং সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। এখন পর্যন্ত এ বাজারটি বন্ধ রয়েছে। তবে দেশের মানুষের প্রধান দৃষ্টি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বিশেষ করে সউদী আরবের দিকে। প্রবাসে গমনেচ্ছুদের বেশিরভাগেরই আগ্রহ ও লক্ষ্য থাকে এ দেশটির প্রতি। তারা মনে করে, দেশটি সবসময়ই ভ্রাতৃপ্রতিম এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের শ্রমিকদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। ফলে তাদের প্রত্যাশা ছিল, ওই দেশের বাজার উন্মুক্ত হলে এর ইতিবাচক প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের দরজা খুলে যাবে। অতীতের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতটি গড়ে উঠতে মূল ভূমিকা রেখেছে সউদী আরব। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্সের জোগানও আসে এ দেশ থেকে। এর কারণ দেশটি অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বেশি প্রাধান্য এবং বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে থাকে। রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে দেশটির সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে। দেশটি সরাসরি কিছু না বললেও বাংলাদেশের শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে অলিখিত নিষেধাজ্ঞারোপ থেকে বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়। সউদী আরবের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের শৈথিল্য যে সাময়িক তা অনেকটাই বোধগম্য ছিল। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভ্রাতৃত্বের টানে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং সউদী আরবের উদার মানসিকতা প্রদর্শনের কারণেই যে সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সউদী আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের দরজা খুলে যাওয়া একটি শুভ বার্তা এবং সুবর্ণ সুযোগ। এর ইতিবাচক প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পড়বে। দেশটি যে সুযোগ দিয়েছে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা এখন সরকারের দায়িত্ব। বহু দেনদরবার করে যে বিষয়টি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনোভাবেই হেলাফেলা করা যাবে না। সততার সাথে এবং অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও আচার-আচরণের বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে। গমনেচ্ছুদের কেউ যাতে ভুয়া ও প্রতারক শ্রেণীর খপ্পরে না পড়ে, এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা, থাকা-খাওয়া এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপালের শ্রমিকদের মতো আমাদের দেশের শ্রমিকরা যাতে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে যৌক্তিক বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পায়, এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধরনের ভুল-ত্রুটির কারণে বহু কাক্সিক্ষত শ্রমবাজারটি যাতে পুনরায় হাতছাড়া না হয়, এ ব্যাপারে সরকারসহ সকলকে সততা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। শ্রমিক পাঠাতে গিয়ে বা পাঠানোর পর দেশের বদনাম হয়, এমন কর্মকা- প্রতিরোধে আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন