শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাবে অপরাধের বিস্তার ঘটছে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক, তিনটি বিভাগের, অর্থাৎ আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো গঠিত। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭ক), চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ (অনুচ্ছেদ ৪৮ থেকে ৬৪), পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতি, অধ্যাদেশ প্রণয়ন ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ ৬৫ থেকে ৯৩) এবং ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ, অধঃস্তন আদালত এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালগুলো (অনুচ্ছেদ ৯৪-১১৭) লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সব অবকাঠামো অর্থাৎ পরিচালনা শক্তি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত ও দায়বদ্ধ থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী, আপিল ও হাইকোর্ট সমন্বয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট গঠিত এবং প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিরা বিচারিক কার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।

স¤প্রতি গণধর্ষণ, পাবলিক প্রকিউরমেন্টে অর্থাৎ সরকারি কেনাকাটায় চুরি, সরকারি টেন্ডারের দখলদারিত্ব এবং আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা অপব্যবহারের মহোৎসব বিগত সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মাদক ও কিশোর গ্যাংসহ অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট অভিজ্ঞজনরা বিভিন্ন প্রশ্ন উপস্থাপনের পাশাপাশি, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার দিকে আঙুল তুলেছেন। দ্রæত বিচার হওয়া যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি মামলার জট কেন সৃষ্টি হচ্ছে তা পর্যালোচনা করে সমাধানের উপায় বের করা দরকার এবং এটাও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার যে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অন্যদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন ও আইন প্রয়োগকারীদের দ্বারা মানুষ ভিকটিম হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির চেয়ে বেশি শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ আদায় করে আসামি বা অভিযুক্তকে ভিকটিম করা হচ্ছে। যার যা প্রাপ্য তাকে তার চেয়ে বেশি শাস্তি দিলে সেখানে আসামি ভিকটিম হয়, আর প্রাপ্যের কম শাস্তি দিলেও ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি’ আইন ও বিচার দিয়ে ভিকটিম হয়। উভয় দিক বিবেচনায় ‘আইন’কে হতে হবে গণমুখী এবং বিচার বিভাগকে হতে হবে বিবেকের প্রশ্নে স্বাধীন ও উন্মুক্ত, যাকে বলা যাবে, Court for Public Interst.


রাষ্ট্র গঠন ও আইন প্রণয়ন পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। তবে রাষ্ট্রের জন্মের পর জন্ম হয় আইনের। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে ‘প্রতিশোধ’ই ছিল বিচারব্যবস্থার মাপকাঠি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকেই নিজের হাতে নিতে হতো বিচারের দায়িত্বভার। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের যিনি ‘মালিক মোক্তার’ অর্থাৎ রাজা, বাদশাহ; তাদের ইচ্ছাটাই ছিল আইন, যা চ্যালেঞ্জ করার এখতিয়ার কারো ছিল না। আজকের যে বিচারব্যবস্থা, কাজে যা-ই হোক, তাকে নামে বলা হয় ‘স্বাধীন বিচারব্যবস্থা’; বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন রাখার জন্য আইনবিশারদ, বিচারক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক অবদান রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের জীবন বেড়ে ওঠে। যেমন- পরিবার, শিক্ষালয়, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বিধিনিষেধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বেড়াজাল এবং রাষ্ট্র। ‘রাষ্ট্র’ নিজেও একটি প্রতিষ্ঠান, যা সংশ্লিষ্ট ভূখন্ডের সর্বময় কর্মকান্ডের অধিকারী। এ কারণেই সামাজিকতার জন্য মানুষকে এক দিকে ‘সামাজিক জীব’, অন্য দিকে নির্দিষ্ট ভূখন্ডসংবলিত একটি রাষ্ট্রের ‘নাগরিক’ বলা হয়। এ দুটো কারণেই একজন মানুষের অনেক দায়বদ্ধতা থাকে। ওই দায়বদ্ধতাকে পদদলিত করে যদি কেউ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজ ইচ্ছামতো চলে, তবে সেখানেই সৃষ্টি হয় ক্রাইম ও ভিকটিম। রাষ্ট্র, ক্রাইম (অপরাধ) ও ভিকটিম (ক্ষতিগ্রস্ত) পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র নিজেও ক্রাইমকে (অপরাধ) জেনারেট করে, অর্থাৎ অপরাধ সংঘটনে উদ্বুদ্ধ করে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো যখন ভারসাম্যহীন হয় তখনই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে ‘ডবল স্টান্ডার্ড রুল’ অনুসরণ করে। রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করেন, ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য সেই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকদের প্রায়ই আপস করতে হয়। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা প্রায়ই বলে থাকেন যে, অপরাধ করলে কাউকে ‘ছাড়’ দেয়া হবে না। কিন্তু এসব উক্তি বাস্তবতার পরিপন্থী, লোক দেখানো মুখরোচক বক্তব্য। রাষ্ট্র অপরাধীর সাথে বিভিন্ন কারণে আপস করে বলেই অপরাধের প্রবণতা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে বঞ্চনা-গঞ্জনার মধ্যেই অপরাধের বীজ লুকায়িত থাকে। সমাজে বঞ্চিতের সংখ্যা অনেক বেশি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বঞ্চিতরা বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিশ্বে উচ্চ শ্রেণি বা ধনিক শ্রেণির মধ্যেই অপরাধী ও অপরাধের সংখ্যা অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার ভিকটিম সমাজের বঞ্চিত মানুষগুলো। যার যার পাওনা তাকে বুঝিয়ে দিলেই সঙ্কটের সৃষ্টি হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ‘সঙ্কটকে’ পুঁজি করে ‘ক্রাইসিস ক্যাপিটাল ইনভেস্ট’ করা হয়। সঙ্কটটিই কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূলধন হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটিই জনগণের জন্য ট্র্যাজিডি।

জন্মগত অপরাধী এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অপরাধী এক হতে পারে না। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই অপরাধ বন্ধ হয় না। অপরাধের বিপরীতে শাস্তি অনেক দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধের প্রসার বৃদ্ধি রোধ হচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ‘শাস্তি দেয়া সহজ, কিন্তু সংশোধন করা সহজ নয়’। নৈতিকতাবোধ ও জীবনের মূল্যায়ন সম্পর্কে গণমানুষকে সচেতন করতে না পারলে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা কোনো মতেই সম্ভব নয়। আধুনিক চলচ্চিত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞানের উন্নয়নের একটি ধাপ হলেও নৈতিকতা ও জীবন মূল্যায়নের প্রশ্নের বিপরীতধর্মী শিক্ষা দিচ্ছে, যার প্রতিফলন ঘটছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এবং এর পরিধি এতই বিস্তার লাভ করছে যে, দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা এর প্রতিকারের দরজা খুঁজে পাচ্ছেন না।

সমাজ ও সামাজিক নিরাপত্তা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পত্রিকা খুললেই মনে হয়, দেশে যেন যৌনতার উৎসব চলছে। ধর্ষণের আগ্রাসন থেকে কেউই যেন মুক্ত নয়। ধর্ষণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য সবাই এখন চিন্তিত। সমাজের কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে, যা সমাধানের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ধর্ষণও এরকম একটি সমস্যা।
অপরাধপ্রবণতা রোধ করার জন্য অপরাধের উৎপত্তিস্থল, অপরাধীর অপরাধমূলক আচরণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি অপরাধকে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক। পুরনো সেই কথা ‘Prevention is better then cure.’ এখন শিরোধার্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ধর্মীয় উন্মাদনা ও ধর্মহীনতা উভয়ই সমাজের জন্য অকল্যাণকর। তবে ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে শিষ্টাচার ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয় এবং একজন মানুষের নিজের কর্মকান্ডের প্রতি জবাবদিহি নিশ্চিত করে তোলে। যে ব্যক্তি নিজের কর্মের জন্য নিজের কাছে জবাবদিহি করতে পারে, তার পক্ষে অত্যাচার, নির্যাতন বা অযাচিতভাবে কারো ক্ষতি করা সম্ভব নয়। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে ‘বকধর্মী’ বুদ্ধিজীবীরা, ধর্মীয় অনুশাসনকে তারা ব্যাকডেটেড মনে করেন এবং ধর্মীয় অনুশাসন মতে কেউ চলতে চাইলে তাকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কিছু বকধার্মিক নিজেদের কুৎসিত নোংরামির সাথে জড়িত করে ধর্মীয় অনুশাসনকে বিতর্কিত করলেও যে পরিবার ধর্মীয় অনুশাসনে চলে তারা সুখে শান্তিতে রয়েছে এবং দেশের মানুষ তাদের হাতে নিরাপদ। ফলে একজন শিশু-কিশোরকে জবাবদিহিমূলক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ‘পরিবার’ই বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যে শিশু বা কিশোর বুঝতে পারে বা মনে করে যে, তার পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত, তখন সে নিজেও মাদক ও অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে, পরিবার শিশুকে তখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং বড় হওয়ার পাশাপাশি সে বিপথে পা বাড়ায়।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন অলিগলি পর্যন্ত পৌঁছেছে। ক্ষমতাসীন কর্তৃক ক্ষমতাহীনদের নির্যাতন, তাদের ব্যবসায় বাণিজ্য জমি দখল করা নিয়েও দুর্বলরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে; সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এবং সুযোগমতো আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়। আইনের যারা রক্ষক অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ পেশাদার ভূমিকার পরিবর্তে যখন ক্ষমতাসীনদের তোষণ করে তখনো ভুক্তভোগীদের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে এবং সে আগুনের লেলিহান থেকেও সৃষ্টি হয় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যা দেশে বিদ্যমান।

ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের দায়িত্ব। অধিকন্তু রয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানকে প্রটেকশন দেয়ার পাশাপাশি সংবিধানে প্রদত্ত ও নির্ধারিত মৌলিক অধিকার থেকে নাগরিকরা যাতে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র সংবিধানের অধীন একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। এ সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, মন্ত্রী, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- সবাই নিজ নিজ বিবেককে দায়বদ্ধ রেখে শপথবাক্য পাঠ করেছেন। তার পরও সংবিধান পদদলিত হচ্ছে, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের জনগণ, যারা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন