আতিকুর রহমান নগরী
ইসলামে বিধর্মী তথা অমুসলিমদের জন্য ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আব্দুল্লাহ মামুন আরিফ বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রের ছায়াতলে যেসব অমুসলিম বাস করে, তাদের জন্য ইসলাম বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মুসলিম পরিভাষায় তাদের বলা হয় ‘জিম্মি’। ‘জিম্মি’ শব্দের অর্থ ‘চুক্তি’ ওয়াদা। এ শব্দটি জানিয়ে দেয় যে, এদের জন্য আল্লাহর এবং তার রাসূলের একটা ওয়াদা রয়েছে। মুসলিম জামাত সে ওয়াদা পালনে বাধ্য। আর তা হচ্ছে এই যে, তারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতে পারবে। আধুনিক ব্যাখ্যায় এরা ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী নাগরিক। প্রথম দিন থেকেই মুসলিম সমাজ এ সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমদের জন্য যে অধিকার, অমুসলিমদের জন্যও সেই অধিকার। তাদের যা দায়-দায়িত্ব এদেরও দায়-দায়িত্ব তা-ই। তবে শুধু আক্বিদা, বিশ্বাস ও দ্বীন-সংক্রান্ত ব্যাপারাদিতে তাদের সাথে কোন মিল বা সামঞ্জস্য নেই। কেননা ইসলাম তাদেরকে তাদের দ্বীন ধর্মের উপর বহাল থাকার পূর্ণ আযাদি দিয়েছে। জিম্মিদের সম্পর্কে নবী করিম সা. খুব কঠোর ভাষায় মুসলমানদের নসীহত করেছেন এবং সেই নসীহতের বিরোধিতা বা লংঘন হতে আল্লাহর অসন্তোষ অবধারিত বলে জানিয়েছেন। হাদিসে নবী করিমের কথা উদ্ধৃত হয়েছে ‘যে লোক কোন জিম্মিকে কষ্ট বা জ্বালা-যন্ত্রণা দিল, সে যেন আমাকে কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণা দিল। আর যে লোক আমাকে জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট দিল, সে মহান আল্লাহকে কষ্ট দিল।’ ‘যে লোক কোন জিম্মিকে কষ্ট দিল, আমি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী। আর আমি যার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী, তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি মামলা লড়বো।’ (আবু দাউদ) যে লোক কোন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির ওপর জুলুম করবে কিংবা তার হক নষ্ট করবে অথবা শক্তি-সামর্থ্যরে অধিক বোঝা তার ওপর চাপাবে কিংবা তার ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া তার কোন জিনিস নিয়ে নেবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে মামলা লড়ব।’ রাসূলে করিম (সা.)-এর খলীফাগণ এসব অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা রক্ষায় সব সময় সচেতন-সতর্ক থাকতেন। ইসলামের ফিকাহবিদগণ মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এসব অধিকার ও মর্যাদার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
অমুসলমানের কাছে সাহায্য চাওয়া : বিশিষ্ট গবেষক আব্দুল্লাহ মামুন বলেছেন যে, মুসলিম অমুসলিমের কাছে দ্বীনী ব্যাপারাদি ছাড়া চিকিৎসা, শিল্প, কৃষি প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে সাহায্য চাইতে পারে, তাতে কোন দোষ নেই। শাসন কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ মানুষ সকলের জন্যই এ অনুমতি রয়েছে। তবে একথা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ যেমন এসব ক্ষেত্রেই মুসলমানদের স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা একান্তই কর্তব্য। নবী করিম সা. নিজে অমুসলিমের কাছ থেকে বিভিন্ন কাজে ও ক্ষেত্রে মজুরির বিনিময়ে সাহায্য নিয়েছেন, কাজ করিয়েছেন। হিজরত করার সময় পথ দেখানোর উদ্দেশে তিনি মক্কার মুশরিক আবদুল্লাহ ইবনে আরীকতের সাহায্য গ্রহণ করেছেন। আলেমগণ বলেন, কেউ কাফির হলে যে কোন বিষয়েই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না, এমন কথা জরুরি নয়। মদিনার পথে মক্কা ত্যাগ করার মতো কাজে পথ দেখিয়ে সাহায্য করার জন্য একজন মুশরিকের সাহায্য গ্রহণ করায় এ পর্যায়ের সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সহজেই দূর হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মুসলমানের নেতার পক্ষে অমুসলিমের কাছে সাহায্য চাওয়া-বিশেষ করে আহলি কিতাবের লোকদের কাছে- সম্পূর্ণ জায়েয বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধে এদের শরীক করা ও বিজয় লাভ হলে মুসলমানদের ন্যায় তাদেরও গণীমতের অংশ দেয়ায়ও নাজায়েয কিছুই নেই। জুহরী বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করিম সা. যুদ্ধে ইয়াহুদিদের সাহায্য নিয়েছেন ও মুসলমানদের ন্যায় তাদেরও গণীমতের মাল দিয়েছেন। হুনাইন যুদ্ধে ছওয়ান ইবনে উমাইয়া মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলে করিম সা.-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করেছেন। তবে শর্ত এই যে, যে-অমুসলিমের সাহায্য গ্রহণ করা হবে, মুসলমানদের ব্যাপারে তার ভাল মত ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। যদি তাদের বিশ্বাস করা না যায়, তাহলে অবশ্য সাহায্য গ্রহণ জায়েয হবে না। কেননা বিশ্বাস অযোগ্য মুসলমানের সাহায্য গ্রহণই যখন নিষিদ্ধ, তখন বিশ্বাস অযোগ্য কাফিরের সাহায্য গ্রহণের তো কোন প্রশ্নই ওঠে না।
অমুসলিমকে হাদিয়া-তোহফা দেয়া : মুসলিম অমুসলিমকে হাদিয়া তোহফা দিতে পারে, তাঁর দেয়া হাদিয়া তোহফা গ্রহণও করতে পারে। নবী করিম সা. অমুসলিম রাজা-বাদশাহের দেয়া হাদিয়া-তোহফা কবুল করেছেন। এ ব্যাপারে বহুসংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত উম্মে সালমা রা. কে নবী করিম সা. বলেছিলেন, ‘আমি নাজ্জাশী বাদশাকে রেশমী চাদর ইত্যাদি তোহফা তথা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলাম।’ বস্তুত ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবেই মর্যাদা দেয়, সম্মান করে। তাহলে আহলে কিতাব, জিম্মি ও চুক্তিবদ্ধ কোন মানুষের সাথে অনুরূপ মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার ও আচরণ অবলম্বিত হবে না কেন? ঘাতক বাহিনীর হাতেই উড্ডীন হলো ইসলামের প্রথম পতাকা মহানবী সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন। তিনি চলেছেন মদিনার পথে। কুরাইশদের ঘোষিত একশ’ উট পুরস্কারের খবর মদিনার প্রতিটি অলিতে গলিতে পৌঁছে গেছে। মদিনার পথে আসলাম গোত্রের গোত্রপতি বুরাইদা তার ৭০ জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। মহানবী সা.-এর কাফেলা যখন সেখানে পৌঁছল, খবর পেয়ে তারা ছুটল। চারজনের ছোট কাফেলা চলছে। পেছন দিক থেকে ছুটে আসছে অস্ত্রসজ্জিত ৭০ জন দুর্ধর্ষ লোকের একটি দল। জাগতিক বিচারে কাফেলাটি একেবারেই অসহায়। মহানবী সা. ও আবু বকর রা. ছাড়া অপর যে দু’জন সাথী আছেন তারা অমুসলিম। চারজনই নিরস্ত্র। এমতাবস্থায় কাফেলাটি এখন শত্রুর হাতের মুঠোয়। কাফেলার অপর সদস্যগণ উদ্বেগ আশঙ্কায় মুহ্যমান। কিন্তু মহানবী সা.-এর মুখে কোন ভাবান্তর নেই, আসন্ন মহাবিপদের সামান্য প্রতিক্রিয়া প্রকাশও মহানবী সা.-এর চোহারা মুবারকে নেই। তিনি কুরআন শরীফ পাঠ করছেন। কুরআনের সুমধুর ধ্বনি তার কণ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আসলাম গোত্রপতি বুরাইদা তার ৭০ জন খুনপিয়াসী সাথী নিয়ে ছুটে আসছে কাফেলার দিকে। একশ উট পুরস্কার তাদের হাতের মুঠোয়। তাদের রক্তে তখন আনন্দ উত্তেজনার তা-ব নৃত্য। তাদের হাতের উলঙ্গ তরবারি ও বর্শা সূর্যকিরণে ঝলমল করছে। বুরাইদার দল ক্রমশ মহানবীর ছোট কাফেলার নিকটবর্তী হচ্ছে। যতই তারা নিকটবর্তী হচ্ছে, মহানবী সা.-এর মুখ নিঃসৃত কুরআনের স্বর্গীয় সুর লহরী তাদের কানে কানে ছড়িয়ে পড়ছে। কান থেকে তা প্রবেশ করছে মন ও মগজে। তাদের কাছে অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে অশ্রুতপূর্ব আয়াতসমূহের ভাব, ভাষা ও ছন্দ। মর্মে মর্মে তা যেন দাগ কেটে বসে যাচ্ছে। বুরাইদা কাফেলার যতই নিকটবর্তী হচ্ছে, ততই তার পা দুটি ভারী হয়ে উঠছে, বাহু যুগল যেন শিথিল হয়ে পড়ছে। লোভাতুর রক্তের সেই তার নৃত্য যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই বুরাইদা তার দলসহ মহানবী সা.-এর কাছাকাছি এসে পড়লো। কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করলেন মহানবী সা.। তারপর বুরাইদার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মধুর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ধাগন্তুক, তুমি কে, কি চাও?’ ‘আমি বুরাইদা, আসলাম গোত্রপতি’ বুরাইদা জবাব দিল। ‘ভালো কথা।’ বললেন মহানবী। ‘আর আপনি কে?’ জিজ্ঞাসা করল বুরাইদা। ‘আমি মক্কার অধিবাসী আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ, সত্যের সেবক, আল্লাহর রাসূল’, উত্তর দিলেন মহানবী সা.। আসলাম গোত্রপতি বুরাইদা মহানবী সা.-এর সাথে কথা বলে, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাব বিহ্বল তায় আত্মহারা হয়ে পড়ল।
মাটিতে বসে পড়ল বুরাইদা। তার শিথিল হাত থেকে বর্শা দ- খসে পড়ল। তার সঙ্গীদেরও এই অবস্থা। অভিভূত বুরাইদা মাহনবী সা.-এর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। মহানবী সা. তাকে সান্ত¡না দিলেন। সে মহানবী সা. কে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘একবার যখন আপনার চরণ তলে আশ্রয় দিয়েছেন, তা থেকে আর আমাদের বঞ্চিত করবেন না।’ বলেই সে উঠে গিয়ে কাফেলার অগ্রভাগে দাঁড়ালো। নিজের মাথার পাগড়ি খুলে বর্শার মাথায় পেঁচিয়ে পতাকা উড্ডীন করলো বুরাইদা। এটাই বোধহয় ইসলামের প্রথম পতাকা। মহানবী সা.-এর পেছনে সত্তরটি নেঙ্গা তরবারী, সত্তরটি বর্শা সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে লাগল। কাফেলা যাত্রা শুরু করল। পতাকা হাতে বুরাইদা একাই আগে চলছিল। উপরে আব্দুল্লাহ মামুনের বর্ণনা থেকে উদ্ধৃতি এনেছি। ইসলামের উদারতা ও ইনসাফকে বিকৃতভাবে দেখার প্রবণতা পরিত্যাগ করতে হবে। কখনোই বিধর্মীকে অনর্থক কথা বলে, তার ধর্মের উপর কুঠারাঘাত করে, তার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে তামাশা করে তাকে কষ্ট দেয়া সমীচীন নয়। বরং তাকে হিকমাত আর প্রজ্ঞার মাধ্যমে সুকৌশল অবলম্বন করে তাওহিদের দাওয়াত দিতে হবে। এটা একজন মুসলমানের নিকট বিধর্মীর হক। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে স্বীয় মনোনিত ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে সহিহ সমঝ দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন