শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

চট্টগ্রাম সিটি মেয়রের অভিযোগ নিয়ে তোলপাড়

প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন যে অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন মহলে তা ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। গত বুধবার চট্টগ্রামে এক সভায় তিনি বলেন, দাবিমত কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলে যেখানে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যেত, সেখানে তা না দেয়ায় এসেছে মাত্র ৮০ কোটি টাকা। আমাকে বলা হলো, করপোরেশনের জন্য যত টাকা চাই দেয়া হবে থোক বরাদ্দ থেকে, তবে পাঁচ শতাংশ করে দিতে হবে। সাম্প্রতিক এক ঘটনা তুলে ধরে তিনি ওই অনুষ্ঠানে আরো বলেন, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পাস করার জন্য একটি নতুন পাজেরো গাড়ি চেয়েছিলেন। তার এই অভিযোগ, বলাই বাহুল্য, অত্যন্ত গুরুতর। গুরুতর যে, তা স্বীকার করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ও। পত্র-পত্রিকায় তার এই অভিযোগপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশের পর সর্বমহলে এটি আলোচনার অন্যতম শীর্ষ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় খুব দ্রুতই নড়েচড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম সিটি মেয়রকে সাত দিনের সময় দিয়ে একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, আপনার আনীত অভিযোগে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে, যার প্রমাণ আবশ্যক। এ প্রেক্ষিতে কোন কর্মকর্তা, কোথায় কখন আপনার কাছে ঘুষ দাবি করেছেন, কে কোথায় কখন পাজেরো জিপ চেয়েছেন, কোন প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে কোন কর্মকর্তা জটিলতা সৃষ্টি করেছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক উপযুক্ত প্রমাণ আগামী সাত দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে দাখিল করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হল। এই চিঠির প্রেক্ষিতে আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, অবশ্যই প্রমাণ দেব। আমি কি রাস্তার লোক? দায়িত্ব নিয়েই কথা বলেছি। সাত দিনের মধ্যেই চিঠির জবাব দেব।
অভিযোগকারী অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করবেন, এটা সঙ্গত কারণেই মনে করা হয় এবং চট্টগ্রাম সিটি মেয়র জানিয়েও দিয়েছেন, তিনি প্রমাণ দেবেন, চিঠির জবাব দেবেন। প্রশ্ন উঠেছে, অভিযোগ ওঠার পর মন্ত্রণালয়ের কি করা উচিত ছিল? অনেকেই মনে করেন, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। তা না করে জট-জলদি অভিযোগকারীর প্রতি চিঠি দিয়ে প্রমাণ পেশ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আ জ ম নাছির উদ্দীন অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত এবং সে ধন্যবাদ তিনি পাবেন, তাতে সন্দেহ নেই। তিনি সাহস করে, দ্বিধা না করে অভিযোগটি তুলছেন। সবাই আশা করে, একই চেতনা থেকে তিনি প্রমাণও হাজির করবেন। পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকদের মতে, আ জ ম নাছির উদ্দীন জনপ্রতিনিধি; তার মিথ্যে বলার কোনো কারণ থাকতে পারে না। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, একজন জনপ্রতিনিধি যখন এ ধরনের অভিযোগ করেন, নিশ্চয়ই তা অমূলক ও ভিত্তিহীন নয়। এটাই তো চলছে, তিনি মিথ্যা বলেননি। শুধু খোলাখুলি বলেছেন। সরকারের উচিত হবে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। সুজনের চট্টগ্রাম সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেছেন, নাছির আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র। আবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যিনি চালাচ্ছেন, তিনিও আওয়ামী লীগের। মেয়রের এ অভিযোগের সত্যতা আছে বলে আমি মনে করি। এখন মন্ত্রণালয়কেই খুঁজে বের করতে হবে, কারা কমিশন ছাড়া কাজ করেন না।
অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ ও কমিশন আদায় আমাদের দেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। এসব অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। সরকারের কোনো অফিস অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত, ঘুষ ও কমিশনবাজির বাইরে আছে, এমন দাবি বুকে হাত দিয়ে কেউ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। সরকারের কোনো অফিসে কাজে গেলে ঘুষ দিতে হবে অবধারিতভাবে। সরকারের যে কোনো ক্রয়, উন্নয়ন কাজ, প্রকল্প ঘুষ-কমিশন ছাড়া হয়, কেউ বিশ্বাস করে না। অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ-কমিশনবাজি সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, এ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। এটা এখন এক ‘অনিবার্য সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা এ যাবত যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে দুর্নীতি কোন পর্যায়ে, কতটা মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে, তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মহল ও দাতা সংস্থাগুলোও দুর্নীতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। অনেকেই জানেন, দুর্নীতির অভিযোগে দাতাদেশ বা সংস্থার অর্থ ছাড় বন্ধ কিংবা প্রদত্ত অর্থ ফেরত নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ভুয়া প্রকল্পের নামে টাকা আত্মসাৎ, ঠিকমত কাজ না করে কিংবা যাচ্ছেতাইভাবে করে অর্থলুট রীতিমত সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সরকার নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পে অর্থের বরাদ্দ অস্বাভাবিক। এর একটা বড় অংশই বেহাত হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। কাজের মান নিয়েও প্রশ্নের অবধি নেই। যে টেকসই উন্নয়নের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, এভাবে সেই টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না। জনগণের ট্যাক্সের টাকা উন্নয়নে যথাযথভবে কাজে লাগবে না, সাতভূতে লুটে নেবে এটা হতে পারে না। সরকারকে অবশ্যই দুর্নীতি রোধে, লুটপাট ও অপচয় নিরোধে কঠোর ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বভাবতঃই আমাদের প্রত্যাশা, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র যে অভিযোগ এনেছেন তার উপযুক্ত ও পক্ষপাতহীন তদন্ত হবে, তদন্তে সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিক সহযোগিতা দেবেন এবং তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন