শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এক জায়গা থেকে বক্তব্য দেয়া উচিত

প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গুলশান-শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ও কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অপারেশন এবং তৎপরবর্তী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। কখন কী ঘটবে, কোন বিপদ আসবে- এ ধরনের শঙ্কা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে জঙ্গিদের ‘মাস্টারমাইন্ড’ নিয়ে একেক সময় একেক রকমের বক্তব্য ও বিবৃতি। এসব বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজ এক ধরনের বক্তব্য দিলে, কয়েক দিন পর তার বিপরীত বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। এর ফলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন বক্তব্যটি ‘সঠিক’ তা বুঝে উঠা সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। গত কিছুদিন ধরে জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ডদের অবস্থান নিয়ে বলা হয়েছে, তারা ভারত পালিয়ে গেছে। এখন অহরহ বলা হচ্ছে, তারা নজরদারিতে আছে, জালে আছে, সার্ভিলেন্সের মধ্যে আছে, দেশে আছে, ঢাকায় আছে, যে কোনো সময় গ্রেফতার ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? তাদের ধরে কেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটানো হচ্ছে না? এমন প্রশ্নবোধক পরিস্থিতির মধ্যেই আরও উদ্বেগজনক খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে আস্তানা গেড়েছে জঙ্গিদের আত্মঘাতী দল। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরময়। পরিকল্পনা আঁটছে বড় ধরনের হামলার। জঙ্গিদের সন্ধানে পুলিশ এখন মাঠে। এ ধরনের খবর যখন পুলিশের সূত্র ধরে প্রকাশিত হয়, তখন সাধারণ মানুষের দিশাহারা হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাদের সন্ত্রস্ত ও ভীতিজনক অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতি শুনে প্রতীয়মান হচ্ছে, তারা যেন জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ডদের অবস্থানের বিষয়টি কৃতিত্বের সঙ্গে জানাতেই বেশি উৎফুল্ল এবং আগ্রহী। শিহরণ জাগানিয়া এক ধরনের রহস্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। আমরা দেখেছি, গুলশান হামলার পর সন্দেহভাজন হাসনাত করিমের গ্রেফতার নিয়ে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে একেকবার একেক বক্তব্য পাওয়া যায়। একবার জানা যায়, তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কোথায় আছে কেউ জানে না। আরেকবার বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে আছে। সর্বশেষ জানানো হয়, তাকে ও আরেক সন্দেহভাজন তাহমিদকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এ ধরনের নাটকীয়তা জনমনে নানা প্রশ্ন ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অন্যদিকে নতুন করে মাস্টারমাইন্ডদের অবস্থান নির্ণয় এবং তাদের গ্রেফতার করা নিয়ে যে ধরনের কথা বলা হচ্ছে, তাতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাস্টারমাইন্ডদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রেফতারে বিলম্ব হলে সাধারণ মানুষের কাছে ভিন্ন বার্তা যাবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, তাদের কাজের মধ্যে কোথাও না কোথাও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, কাজের চেয়ে কথা বেশি হলে, অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি মাস্টারমাইন্ডদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই থাকে, তবে তাদের যতদ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করাই সঙ্গত। তা না করে যদি আগেভাগেই তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হয়, তবে তারা কি সেই অবস্থানে বসে থাকবে? অনেকে মনে করছেন, মাস্টারমাইন্ডরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কব্জার মধ্যেই আছে। বিশেষ কোনো কারণে প্রকাশ করা হচ্ছে না। অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে একেক সময় একেক বক্তব্য দেয়ায় যেমন নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও রহস্য সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি জনমনে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। জনসাধারণের মধ্যে বিরাজমান এই নিরাপত্তাহীনতা প্রলম্বিত হতে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানুষকে যদি সর্বক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়, তবে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করবে কিভাবে? তাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত কর্মস্পৃহা জাগ্রত হবে কিভাবে? মানুষের এই শঙ্কিত মনোভাবের প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়তে বাধ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। এই স্থবিরতা বাড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গি হামলা। বিনিয়োগ ক্ষেত্রে তথৈবচ অবস্থা। দিন দিন ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমছে। স্বাভাবিক জীবন-যাপনের মতো অর্থ মানুষের হাতে নেই। সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষের নিরাপত্তাজনিত অতি স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর দ্রুত সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। কোনোভাবেই তা প্রলম্বিত হতে দেয়া উচিত নয়।
অপরাধীর অবস্থান নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বা তাদের বরাত দিয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য দেয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশিত হয়। পৃথিবীতে এমন নজির খুব কমই রয়েছে, ভয়ংকর অপরাধী বা চক্রকে শনাক্ত এবং অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রেফতার করা হয়না বা বিলম্ব করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজই হচ্ছে, ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে অপরাধীকে দমন করে জনসাধারণকে ভয়মুক্ত করা, আশ্বস্ত করা। আমরা লক্ষ্য করছি, জঙ্গি মাস্টারমাইন্ডদের নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রমাগত বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। অথচ এসব কথা তখনই যুক্তিযুক্ত হতো যখন মাস্টারমাইন্ডদের গ্রেফতার করে তাদের অবস্থানসহ বিস্তারিত বলা হতো। আমরা বরং উল্টোটা দেখছি। পরের কথা আগে বলে দেয়া হচ্ছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয়, মাস্টারমাইন্ডদের সম্পর্কে জনগণকে তথ্য জানাতে হবে, তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে কোনো একটি জায়গা থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেয়া সমীচীন। একেক সময় একেক বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তি ও প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ দেয়া উচিত নয়।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন