শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

প্রসূতি সেবায় এখনো ভরসা দাই

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০০ এএম

‘হাসপাতালো শরম করে। বেডারা-বেডিরা দেখবো কিমুন জানি লাগে। আবার টেকাও লাগে অনেক। আমরা গরীব মানুষ স্যার। এত্তো টেকা কইত্তে দিমু। হেইত্তে ভালা গেরামের ধরনি (দাই)’।
কথাগুলো বললেন খামারপাড়া গ্রামের আলাতুননেছা। স্বামী রকমত আলী দিনমজুর। দিনমজুর স্বামীর সংসারের ঘানি টানতেই হাঁসফাঁস অবস্থা। স্ত্রীর সিজার করতে প্রয়োজন অনেক টাকা। তাই শরণাপন্ন হলেন দাইয়ের। দাই তার শেষ ভরসা। শুধু আলাতুননেছা নয়, রূপগঞ্জের ও রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলের ৩০ ভাগ গর্ভবতীর প্রসূতি সেবায় এখনো শেষ ভরসা দাই।
সরেজমিনে ঘুরে দাইদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি ব্লেড, সুতা, সাবান আর পরিষ্কার কাপড়ের টুকরা নিয়ে তারা ছুটে যান প্রসব বেদনায় কাতর নারীদের কাছে। প্রসূতি মায়ের পেটে হাত দিয়ে কিংবা কান পেতে বুঝে নেয় গর্ভে থাকা সন্তান এখন কোন অবস্থায় আছে। তাদের নেই কোন প্রশিক্ষণ, নেই শিক্ষা, নেই কোন চিকিৎসার যন্ত্রপাতিও। তারাই গ্রামে গ্রামে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাশাপশি ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সমাজে তাদের পরিচিতি দাই হিসাবে। কেউ বলেন ধাত্রী। আবার কোন এলাকায় দাই মা হিসেবে পরিচিত।
চিকিৎসা সেবায় দাই হিসেবে পরিচিতি পেলেও এদের কোন নির্ধারিত বেতন-ভাতা নেই। নেই নির্ধারিত ফি। সন্তান প্রসবকালীন গর্ভবতী মায়ের ব্যাথা থেকে শিশু ভ‚মিষ্ঠ পর্যন্ত দাইরা ২-৩ দিন টানা শ্রম দেন। তারপরও নেই কোন অর্থকড়ির চাহিদা। হয় না দর কষাকষি। তবে তারা পুরষ্কৃত হন ছোট-খাটো উপঢৌকনে। চাকরির মতো কোন বাধ্যবাধকতা নেই। একান্তই স্বাধীন কাজ। তবুও অন্যের বিপদে গভীর রাতে ডাক পড়লে কাউকে আজ অবধি বিমুখ হতে হয়নি।
কথা হয় নগরপাড়া এলাকার দাই রাশিদা বেগমের সঙ্গে। এ পর্যন্ত প্রায় একশ’ শিশু মাতৃগর্ভ থেকে তার হাত ধরে পৃথিবীর আলো দেখেছে। নিজ থেকেই এ কাজটি শুরু করেন তিনি। আজ অবধি কোন মা ও শিশুর দুর্ঘটনা ঘটেনি। খামারপাড়া গ্রামের করিমন নেসা। স্বামী আব্দুল হামিদ গত ৫ বছর আগে মারা গেছে। ৩০ বছর ধরে দাইয়ের কাজ করছেন। আড়াইশ’ শিশু দুনিয়ার আলো দেখেছে তার হাতে। ৪৫ বছরের দুধনাহার। বাড়ি তালাশকুর গ্রামে। স্বামী আরো ১০ বছর আগে মারা গেছেন। ২০ বছর বয়স থেকেই দাইয়ের কাজ করে আসছেন। আয়াতুননেছা, করিমুন নেসা আর দুধনাহারেরর মতো উপজেলার বিভিন্ন এলাকার আরো ৩২ দাই প্রসূতি সেবায় নিয়োজিত।
প্রসবকালীন ব্যাথা ওঠলে খবর পেয়ে দাই ছুটে যান রোগীর কাছে। সঙ্গে নেন একটি সাবান, কয়েক টুকরা পরিষ্কার কাপড়, কয়েক চামচ নারিকেল তেল, একটি ব্লেড। গ্রামে বসে দাইয়ের কাজ করতে হয় বলে তাদের কোন গ্লাভস নেই। বাচ্চা স্বাস্থ্যবান হলে জরায়ুতে তেল ব্যবহার করেন। ব্লেড দিয়ে নাভি কাটা হয়। গ্লাভস নেই বলে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়।
তবে দাইরা বলেন, গর্ভের সন্তান বেশি স্বাস্থ্যবান হলে জরায়ু কাটতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রসবকারিনীকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়। নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালে। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয় মা ও শিশুকে। এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য দাইদের সেলাই ও কাটা প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেয়া হলে প্রসবকারিনীকে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব।
পেশা না হলেও পেশাজীবী মানুষের চেয়ে এরা অধিক বেশি পরিশ্রমী এবং দায়িত্ববান। তারপরও তাদের জন্য সরকারিভাবে আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। নেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভালো উদ্যোগ। কথা হয় দাই জয়নব বিবি, জহুর বানু, ফুলবানু, হুরবানু, আনোয়ারা বেগমসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও প্রেসার মাপার যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় সকল প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতি দেয়া হলে গ্রামে সন্তান প্রসবকালীন মায়েদের অনেক ভালো মানের সেবা দেয়া সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন