কৃষি নির্ভর দিনাজপুর অঞ্চলে গরুর খাবার খড়ের সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দা ভাব সারা বিশ্বের মত দিনাজপুরেও দেখা দেয়। এর মধ্যে অতিবর্ষণ ও বন্যা মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দেখা দেয় গ্রামাঞ্চলে। এতে বাড়ী-ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হলেও কৃষকেরা নিজ জীবনের পাশাপাশি গবাদি পশুকে রক্ষা করে উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। তবে গবাদি পশুর অন্যতম খাদ্য খড় রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
ফলে বন্যা কবলিত এলাকায় গো-খাদ্যের চরম সঙ্কট দেখা দেয়। সুযোগ বুঝে বেপারীরা নেমে পড়ে খড়ের ব্যবসায়। দিনাজপুরসহ যে সকল এলাকায় বন্যা দেখা দেয়নি সে সব এলাকায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে খড় সংগ্রহে। বেপারীদের বেপরোয়া আচরণে এসব অঞ্চলে ধানের চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি দাম হয়ে যায় খড়ের। খামারির পাশাপাশি কৃষক পড়ে যায় চরম বিপদে। তবে খামারিদের চেয়ে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে সাধারণ কৃষক। কেননা গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি কৃষকের ঘরে এক-দুটি করে গরু থাকে। গরুর দুধ বিক্রির পাশাপাশি কোরবানির সময় গরু বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা রোজগার করে থাকে কৃষক।
গরু পালনের জন্য সাধারণত আমন ধানের খড় গো-খাদ্যের উপযোগী হওয়ায় কৃষক তা যত্ম সহকারে সংরক্ষণ করেন। একইসাথে আমন খড় বাড়ির চালা (ছাদ) ছাউনিতেও ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে পরবর্তী আমন ধান না উঠা পর্যন্ত এই খড় দিয়ে পালন করা গরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। এর মাঝে বোরো ধান উঠলেও এ থেকে লম্বা বা থোক হিসাবে খড় পাওয়া যায় না। এছাড়া বোরোর খড় গবাদিপশু সে রকমভাবে খায় না। ফলে গো-খাদ্যের জন্য আমন খড়ের চাহিদা সর্বাধিক। তবে খামারিরা খড়ের পাশাপাশি আবাদ করা ঘাস, চালের খুদ, ফিড ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। খড়ের সঙ্কট এবং দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় খাদ্যের অভাবে গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক।
চলতি বছর অতিবর্ষণ ও একাধিকবার বন্যার কারণে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় খড়ের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকায় এবার ৪ থেকে ৫ দফা বন্যা হয়। বন্যা ও নদী ভাঙনে বাড়ী-ঘর সব শেষ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এসব এলাকায় গো-খাদ্যের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অপরদিকে অতিবর্ষণ হলেও এবার দিনাজপুরে বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়নি। ফলে এই এলাকার কৃষকদের ঘরে খড়ের মজুদ ছিল। কিন্তু বন্যা কবলিত এলাকায় খড়ের চাহিদার কারণে বেপারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে দিনাজপুরের গ্রামাঞ্চলে। স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি দামে খড় কিনতে থাকে ব্যাপারীরা। ট্রাক, ট্রাকটর ভর্তি করে নিয়ে যেতে থাকে বন্যা কবলিত এলাকাগুলিতে। ট্রাক ভর্তি করে এসব খড় নিয়ে যাচ্ছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ রংপুর গাইবান্ধা লালমনিরহাট সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায়।
এসব এলাকায় গো-খাদ্য খড় সোনার হরিণের মত হয়ে গেছে। এদিকে করোনার কারণে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া কৃষকেরা নিজেদের প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে চড়া দামে খড় বিক্রি করে দেয়। একপর্যায়ে দিনাজপুরেও খড়ের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। খাদ্য সঙ্কটের কারণে দিনাজপুরের খামারি ও কৃষকেরা গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে উঠতি আমন ধানের গাছ কেটে গরুকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
দিনাজপুরের বিরল, কাহারোল, বোচাগঞ্জ, চিরিরবন্দর উপজেলাসহ জেলার প্রতিটি গ্রাম, ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর, রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ উপজেলায় বেপারীরা চসে বেড়াতে থাকে খড়ের জন্য। সাধারণত ২’শ টাকা দরের এক পোন (কাড়ির হিসাব) খড়ের দাম লাফিয়ে হাজার টাকায় উঠে যায়। ফড়িয়ারা এসব খড় ট্রাক ভাড়া করে নিয়ে যেয়ে বন্যা কবলিত এলাকায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে।
বেপারী আবদুল মালেক জানান, ট্রাক ভর্তি করে খড় নিয়ে গেলেই টাকা। বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলিতে চালের জন্য যত হাহাকার নয় তার চেয়ে চাহিদা খড়ের। ঐ সব এলাকার কৃষকেরা খড়ের গাড়ীর অপেক্ষায় বসে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে এখন টাকা দিয়েও খড় পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি ভূষি, চালের গুড়াসহ অন্যান্য গো-খাদ্যের দামও বেড়ে গেছে।
এদিকে খড় সঙ্কট দেখা দেয়ায় গ্রামের ভূমিহীন কৃষকেরা এখন ভ্যান ও সাইকেলে করে খড় বিক্রি করার ব্যবসায় নেমে পড়েছে। অজো পাড়া-গাঁ থেকে খড় কিনে উপজেলা শহর ও আশপাশ এলাকায় ফেরী করে খড় বিক্রি করছে। ষাটোর্ধ আলিমউদ্দিন জানালেন, সাইকেলে খড় বিক্রি করে প্রতিদিন সংসার চালানোর খরচ উঠে আসে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন