প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, দেশ ও জনগণের বোধ ও বিবেকের কণ্ঠস্বর, রাজনীতিক, সমাজসেবক ও দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর আজ দশম ইন্তেকালবার্ষিকী। আজকের এই দিনে আমরা তাকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ১৯৩৫ সালে চাঁদপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য, গতিশীল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী দেশের এই কৃতী সন্তান আমৃত্যু দেশ ও জনগণের খেদমতে নিবেদিত ছিলেন। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৭১ বছর বয়সে তার বহুকীর্তিময় জীবনের অবসান ঘটে। তার এই জীবন পরিসরে তিনি এত কাজ করছেন, দেশজাতির কল্যাণে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন যার সংক্ষিপ্ত বিবরণও এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তার প্রতিটি কর্ম জাতীয় জীবনে মাইলফলক হয়ে আছে। সারাটি জীবন তিনি দেশ, জাতি, শিক্ষা ও ধর্মের সেবায় অতিবাহিত করে গেছেন। যৌবন থেকে বার্ধক্য, জীবনের প্রতিটি বাঁকে ও স্তরে নানা মহৎ কর্মে, নানা পরিচয়ে তিনি নিজেকে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর করে গেছেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষক হিসেবে। সে ক্ষেত্রে তার কীর্তি ও অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি মাদরাসা শিক্ষক থেকে জাতির শিক্ষকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। মাদরাসা শিক্ষকদের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসাবে, তৌহিদী জনতার মুখপাত্র দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, ঢাকার মহাখালিতে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ মসজিদে গাওসুল আজম কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে তিনি কেবল কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব হিসাবেই নন্দিত নন, নিজে একটি প্রতিষ্ঠানেও পরিণত হয়েছিলেন।
আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাক্রম ও ক্রমবিকাশে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষক সমিতির অবিসংবাদি নেতা হিসেবে শিক্ষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন তার তুলনা বিরল। দেশের ক্রান্তিকালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে তার অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি ১৯৭৯ সালে এবং ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পর্যায়ক্রমে শিক্ষা, ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে স্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৮ সালে শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যা ও দুর্যোগের সময় ধর্ম, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসেবে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে তিনি সারা বিশ্বে সুপরিচিত ছিলেন। তার এই ব্যক্তিগত পরিচিতি, খ্যাতি ও যোগাযোগ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো থেকে বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে তিনি সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইসলাম, মুসলিম বিশ্ব এবং দেশ ও জনগণের বৃহত্তর খিদমতে একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন। এ ধরনের একটি সংবাদপত্রের প্রকাশ ছিল তার স্বপ্ন। কিছুটা বিলম্বে হলেও তার এ স্বপ্ন পূরণ হয় দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর মতো বিদ্বান, দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও কর্মীপুরুষের এখন খুবই আকাল। দেশ নানাদিক দিয়ে এখন যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তার প্রেক্ষাপটে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর মতো নেতা, বহুদর্শী ব্যক্তিত্ব ও পথপ্রদর্শকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তার ইন্তেকালের পর দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, অপরিণামদর্শিতা ও হঠকারিতার যে সয়লাব চলছে, যে দুর্ঘট পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এ মুহূর্তে তার মতো মানুষের কথাই বার বার মনে পড়ছে। পুরো জাতি এখন রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, পুলিশি নির্যাতন ও দুষ্কৃতদের দৌরাত্ম্যে দিশেহারা। সকল ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে, জাতীয় কল্যাণ অগ্রাহ্য হচ্ছে। ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে নানাভাবে মুসলমানরাই নিগ্রহ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ‘খামোশ’ বলার কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর প্রাণপ্রিয় সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইনকিলাব নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশ-জাতির খিদমতে কাজ করে যাচ্ছে। তার সুযোগ্য পুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রচেষ্টায় ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর একটি বড় স্বপ্ন ছিল এই ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখন বাস্তব রূপ পেয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবও তার দেখানো পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। দেশ ও জনগণের পক্ষে দৈনিক ইনকিলাব নির্ভীক ও আপসহীন। তার প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠান দেশ-জাতির কল্যাণে এই ভূমিকা আগামীতেও রেখে যাবে, এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। আমরা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর রূহের মাগফেরাত কামনা করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন