বাংলাদেশ ভারত এবং মিয়ানমারকে যুক্ত করতে দিল্লী ৬ হাজার ৯০ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস বিষয়ক মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র একথা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ কি এবং কতটা এ সংক্রান্ত একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রশ্নের জবাবে কোন পূর্ণ বিবরণ বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ দেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের ভারতীয় উদ্যোগ দু’দেশের জ্বালানি সহযোগিতায় একটি নতুন উন্নয়ন সূত্র। ভারতীয় দৈনিক দ্যা স্টেটসম্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, ভারতের জ্বালানি মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বলেছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে একটি পাইপলাইন স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তেল ও গ্যাস সরবরাহের জন্য ভারতের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কনতাইয়ের মধ্য দিয়ে হলদিয়া থেকে দত্তপুলিয়া হয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দিকে একটি পাইপলাইন স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তিনি আরো বলেছেন, আমরা বাংলাদেশী বন্ধুদের সাথে আলোচনা করেছি এবং বাংলাদেশে পাইপলাইন পাঠানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছি। শিলিগুড়ি হয়ে পাইপলাইনটি আবার ভারতে প্রবেশ করানোর বিষয়েও আলোচনা চলছে। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর করার কথা রয়েছে। তার আগেই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ভারত সফরে আসছেন। আমরা দু’জনে মিলে জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করব যাতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আরো চুক্তি করতে পারে।
ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারকে সংযুক্ত করে ৬ হাজার ৯শ’ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানোর উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন দেশটির তেল ও প্রাকৃতি গ্যাস করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক এসসি সোনি। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, হাইড্রোকার্বন ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে এ দীর্ঘ পাইপলাইন বসানো হবে। এই পাইপলাইন মিয়ানমারের সিটওয়ে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ভারতের বেশিরভাগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসহ শিলিগুড়ি ও দুর্গাপুরকে সংযুক্ত করবে। তিনি জানিয়েছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে গ্যাস সহায়তার জন্য বন্দর নগরী চট্টগ্রামে তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের একটি টার্মিনাল প্লাণ্ট স্থাপনের জন্য এ বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও ইন্ডিয়ান ওয়েল করপোরেশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত একটি পাইপলাইন স্থাপনের নির্মাণ কাজের জন্য আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড ওবিপিসি’র মধ্যে একটি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে হাইস্পীড ডিজেল সরবরাহের জন্য একটি পাইপলাইন বসানো হবে। এলপিজি ও এইচএসডি সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ মিয়ানমার ও ভারতের মধ্যে পাইপলাইন স্থাপনের বিষয় চূড়ান্ত করতে গত সপ্তাহে গোয়াহাটিতে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটি বৈঠক হবে এ বছরের শেষের দিকে আগরতলায়। এই পাইপলাইনের জন্য প্রস্তাবিত ১৩টি রুটের মোট দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৯শ’ কিলোমিটার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস পুড়ছে। এগুলোকে ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এই গ্যাসকেই উৎপাদনশীল কাজে সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আমরাও অভিনন্দন জানাই। কারণ, বাংলাদেশ অনেকদিন থেকেই গ্যাস সংকটে ভুগছে। আমাদের দেশে এখন গ্যাসের সরবরাহ অত্যন্ত জরুরী। দেশের শিল্পখাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে এখন গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে এখন গ্যাসের চাহিদার তুলনায় ৫ কোটি ঘনফুটের উৎপাদনজনিত ঘাটতি রয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রান্না-বান্নার জন্য গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারেরও ১০ টিসিএফ গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে। দেশটি চীন ও থাইল্যান্ডে গ্যাস রফতানি করছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে যে গ্যাস পাইপলাইন হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে তা থেকে বাংলাদেশের প্রয়োজন কতটা মিটবে সেটাই হলো প্রধান বিবেচ্য বিষয়। গ্যাসলাইন সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্যাস প্রাপ্তি ছাড়া রাজস্ব কতটা কি পাওয়া গেল সে বিষয়টি এখানে লঘু। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোন পূর্ণ বিবরণ না দেয়াতে অবশ্যই কিছু মৌলিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ কোন দেশের উৎপাদনশীলতায় এই গ্যাস ব্যবহৃত হবে সেটি অবশ্যই দেখার বিষয় রয়েছে। জ্বালানি বিষয়ক যেসব আলোচনার প্রাসঙ্গিক খবর একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে তাতে খুব স্পষ্ট করে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা উল্লেখ নেই।
ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইনকে আমরা স্বাগত জানাই যদি এটি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে যায়। ত্রিদেশীয় পাইপলাইনের আলোচনাও অনেক দিনের পুরনো। এখন তা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে বা যাবার পথে রয়েছে।
আমরা এর আগেও একথা সংশ্লিষ্টদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, আলোচ্য সংযোগ থেকে বাংলাদেশের গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হুমকির মুখ থেকে বেরুতে পারবে না। উন্নয়নে গ্যাসের কোন বিকল্প নেই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গ্যাস পাওয়া নিয়ে ইতোপূর্বেও আলোচনা হয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টেও বলা হচ্ছে সেখানে প্রচুর অতিরিক্ত গ্যাস রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে অবশ্যই আমরা সে গ্যাস নিতে পারি। এ নিয়ে ইতোপূর্বে যেসব আলোচনা হয়েছিল সে প্রসঙ্গ এখন আর তুলে লাভ নেই। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই চুক্তি সম্পাদিত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগেই বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরী। সংশ্লিষ্ট সকলে এ ব্যাপারে সতর্ক ও যতœবান হবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন