সরকারের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের অভ্যন্তরীণ যোগানদাতা এনবিআর বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। রাজস্ব আদায় সক্ষমতার উপর জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা ও অস্বচ্ছতা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সরকারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে বাধ্য। গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, রাজস্ব আদায়ের সাফল্য এবং ঘাটতি সম্পর্কে বড় ধরনের বিভ্রান্তির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে রাজস্ব আয়ে শতকরা ৩০ ভাগ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় বাজেটে অর্থ যোগানের অঙ্ক নির্ধারণ করা হলেও বছর শেষে আদায় হয়েছে মাত্র ১৪.৬০ ভাগ যা প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম। টাকার অঙ্কে ঘাটতির পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ববোর্ড তার এই ব্যর্থতা আড়াল করতে এক পর্যায়ে ২৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করে বছর শেষে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে দাবী করে। রাজস্ব আদায়ে চরম ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও সীমাবদ্ধতাসমূহ চিহ্নিত করে করে তা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে আত্মপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। রাজস্ববোর্ড কর্তৃপক্ষের এ ধরনের ফাঁকিবাজি প্রবণতা বাজেট বাস্তবায়নসহ সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
এমনিতেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লালফিতার দৌরাত্ম্যসহ প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অপচয়ের শিকার হওয়ায় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরকারী বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের মূল উৎস ও চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য এনবিআর’র সক্ষমতা,স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া জরুরী। রাজস্ব আদায়ে এনবিআর’র লক্ষ্যমাত্রা এবং দাবীর সাথে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিজিএ)অফিস এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। এনবিআর নিজেই অস্বচ্ছতা ও বিভ্রান্তির দ্বারা নিজের ব্যর্থতাকে জায়েজ করতে চাইলে রাজস্ব আদায়ে স্টেকহোল্ডারদের কাছে আস্থাহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। জাতীয় রাজস্ববোর্ডের প্রতি করদাতাদের এ ধরনের অনাস্থা রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যর্থতা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো থেকে রাজস্বের প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে। বাজেট সংস্থানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দেশের বেসরকারী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও সমন্বয়হীনতা কারণেই রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা চলতে দেয়া যায় না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার উৎসে কর ফাঁকি হচ্ছে। গত অর্থবছরে আয়কর খাতের রাজস্বের শতকরা ৫৭ ভাগই এসেছে উৎসে কর কর্তন থেকে। রাজস্ব খাতের সবচেয়ে বড় এই খাতে বড় ধরনের ফাঁকি বা গলদ রয়েছে, এ ফাঁকিবাজি বন্ধ করা গেলে আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, অর্ধশতাধিক উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীল আয়করের এই খাতের গলদ নিয়ে এনবিআর যথাযথ রিপোর্ট তুলে ধরলেও সামগ্রিক রাজস্বখাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ঘাটতি মোকাবেলায় করনীয় নির্ধারনে এনবিআর কর্তৃপক্ষের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারনের পর ৫ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত বা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী দেখানোর যে হিসাব এনবিআর দিয়েছে সেখানে বকেয়া রাজস্ব, মামলাসহ বিভিন্নভাবে পাওয়া ২০ হাজার কোটি টাকা যোগ করে হিসাব দেয়া হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। নিজেদের হিসাব-নিকাশ ও তথ্যে গরমিল রেখে অধীনস্থ অন্য সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা কতটা সম্ভব সংশ্লিষ্টদের তা ভেবে দেখতে হবে। গত তিন অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারনে উল্লম্ফন এবং হ্রাসকরণের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং এনবিআরের অক্ষমতাকেই নির্দেশ করে। এ ধরনের ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা দূর করে রাজস্ব আদায় আরো গতিশীল, স্বচ্ছ এবং জনবান্ধব করতে হবে। তা না করে এনবিআর র্যাব দিয়ে ভ্যাট আদায়ের চেষ্টা করেছে। রাজস্ববোর্ড এবং করদাতা এবং বাজেট বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সুসম্পর্ক ছাড়া অবস্থার প্রত্যাশিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। একদিকে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যবসায়ী ও করদাতাদের অহেতুক বিড়ম্বনার শিকারে পরিণত করা, অন্যদিকে গরমিল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে নিজেদের সক্ষমতা ও সাফল্য প্রমাণের চেষ্টা পরিহার করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন