আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশকে অবিবেচ্য রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই দুয়ের যথাযথ সমন্বয় সাধানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ সংরক্ষন করে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত করা যায় তাকে টেকশই উন্নয়ন বলে। বিষেয়ে গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (২০১৫-২০৩০) প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র (২০১০-২০২১) প্রণয়ন করেছে। এই অধ্যয়নের মূল লক্ষ্য জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন কৌশলের বিশ্লেষণ এবং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। প্রবন্ধটি প্রণয়নে বর্ণনা ও বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তুলনামূলক পদ্ধতিও প্রয়োগ করা হয়েছে। গবেষণাকর্মটি থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ইসলামে টেকসই উন্নয়ন ব্যাপক অর্থবোধক ও বিস্তৃত এবং তা নৈতিক দিকসহ আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত দিকগুলোর অন্তর্ভুক্ত করে। এ কারণেই একে পশ্চিমা উন্নয়ন মডেলের বৈশিষ্ঠ্য থেকে সহজেই পৃথক করা যায়। পুঁজিবাদী সমাজ শুধু মুনাফাকামিতা ও বস্তুগত চাহিদা পূরণকেই টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কিন্তু ইসলাম গঠনমূলক উৎপাদানের পাশাপাশি মানবীয় মূল্যবোধ রক্ষা করাকে ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহন করে।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশ ব্যতীত মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ও মানুষ পরিবেশের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারেনি। বিগত শতকের শুরুতে মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, পরিবেশ যতই দূষিত হোক না কেন প্রকৃতির নিয়মে তা আবার পরিশোধিত হবে। বিংশ শতকের ৬০-৭০ এর দশকে পরিবেশের দূষন নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে,পরবর্তীতে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,পরিবেশ তাঁর নিজস্ব নিয়মে পরিশোধন হতে অক্ষম, মানুষকেই পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে। ২০১৫ সালে শেষ হতে যাওয়া সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতির ধারা আরো বেগবান করার অভিপ্রায়ে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ৭০ তম অধিবেশনে গৃহীত হয়েছে ১৫ বছর মেয়াদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বা Sustainable Development Goals (SDG)। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশল পত্র (২০১০-২০২১) প্রণয়ন করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন শুধু বস্তুগত বিষয় নয় বরং নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করে। এ উন্নয়ন সম্পর্কে ইসলাম নির্দেশনাকে অন্যসব টেকসই উন্নয়ন মডেল থেকে সহজেই পৃথক করা যায়।
টেকসই উন্নয়ন ঃ টেকসই উন্নয়ন একটি সামাজিক পরিভাষা। স্থিতিশীল উন্নয়ন বা উন্নয়নের স্থিতিশীলতা উভয় ক্ষেত্রে শব্দটির প্রয়োগ করা হয়। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Sustainable Developmentএবং আরবী প্রতিশব্দ আত্তানইনয়্যাতুল মুস্তাদালাহ। পরিবেশকে ভিত্তি করে সংঘটিত আর্থ সামাজিক উন্নয়নই হলো টেকসই উন্নয়ন। অর্থ্যাৎ উন্নয়ন গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হলো টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন বলতে শুধু ভবিষ্য প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান প্রজন্মের ভোগ সীমিতকরণকেই বোঝায় না, বরং এটি সংখ্যালঘিষ্ঠের অটেকসই ভোগের কারণে বর্তমান প্রজন্মের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্থ না হয় তা ও নিশ্চিত করে। অতএব টেকসই উন্নয়নের আরেকটি মাত্রা হচ্ছে আন্তপ্রজন্মগত সমতা। অন্যকথায়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সমবন্টন।
টেকসই উন্নয়ন প্রসঙ্গে এস. শচিমেডেইনি বলেন: Sustainable Development is a new concept of development that emphasises the integration of environmental conservation and economic growth. Previously, the concept of development was synonymous with economic growth which can be quantified by certain parameters such as gross domestic product (GDP). In fact the concept of Malaysian Journal of Science and technology Studies development has a wider meaning than the concept of growth because development means increase of quality of life while growth only emphasises increase of the economy.
টেকসই উন্নয়ন হলো উন্নয়নের এমন এক নতুন ধারণা, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে সমন্বয় সাধনে গুরুত্ব আরোপ করে। পূর্বে উন্নয়নের ধারণাটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমার্থবোধক হিসেবে বিবেচিত হতো, যা মূলত সুনির্দিষ্ট পরামিতি যেমন জাতীয় উৎপাদন (এউচ) এর ভিত্তিতে পরিমাপ করা হতো। প্রকৃতপক্ষে, মালয়েশিয়ান জার্নাাল অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি স্টাডিজ’। এর দৃষ্টিতে উন্নয়নের ধারণা প্রবৃদ্ধির চেয়ে ব্যাপকতর । কেননা উন্নয়ন অর্থ হলো, জীবন মানের উন্নন পক্ষান্তরে প্রবৃদ্ধি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপর গুরুত্বরোপ করা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে: টেকসই উন্নয়ন মূলত একটি প্রক্রিয়া, যা দ্বারা জনগণ তাদের চাহিদা মেটায়, তাদের বর্তমান জীবন যাত্রার মানের উন্নতি ঘটায় এবং সেই সাথে ভবিষৎ প্রজন্ম যাতে তাদের আপন চাহিদা পূরণ করতে পারে তাদের সেই সামর্থ্যরে সুরক্ষা করে। আর.ই.মুন টেকসই উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলেন: The meaning of development is sustainable Development refers to play quality enhancement of human and other spheres by achieving their basis needs. Clearly the concept of development here has a more comprehensive meaning than economic growth.
টেকসই উন্নয়নে উন্নয়নের পরিভাষাটি মানব জাতির মৌলিক চাহিদা পূরনের মাধ্যমে তাদের জীবন মান ও অন্যান্য সূচকের বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। বস্তুত এখানে উন্নয়নের ধারণাটিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে ব্যাপক অর্থবোধক। মানুষের বাঁচার ন্যূনতম প্রয়োজন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, পানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজন মিটানো এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা; জনসংখ্যাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রাখা; আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি পুনবন্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ; খনিজ সম্পদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে তার আবর্তনের উপর জোর দেয়া; প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে ভোগ; পানি ও বায়ূ দূষন নিয়ন্ত্রনে রাখা; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার উপর জোর দেয়া; গ্রাম উন্নয়নের উপর জোর দেয়া, যাতে গ্রামের লোকেরা শহরের দিকে না আসে; সুষম ভূমি ব্যবহার এবং তা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আনা; শক্তি তথা এনার্জির ক্ষেত্রে পুনর্নবায়নযোগ্য উৎসের উপর নির্ভর করা। অতএব বলা যায়, পরিবেশকে ভিত্তি করে সংঘটিত আর্থ সামাজিক উন্নয়নই হলো টেকসই উন্নয়ন। অর্থ্যাৎ পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে সংঘটিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অর্জিত হয়। যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, যেখানে প্রতিটি মানুষ উন্নয়নে অবদান রাখার ও এর সুফল ভোগের সুযোগ লাভ করে এব একই সময়ে তারা প্রাকৃতিক ইকোসিষ্টিমের সুরক্ষা সহ সংরক্ষন করে থাকে।
টেকসই উন্নয়নের ধারণা ঃ জাতিসংঘ পরিবেশের বিষয়ে মুখ্য অধিবক্তা এবং টেকসই উন্নয়ন এর নেতৃত্বস্থানীয় প্রচারকের দায়িত্ব পালন করছে। আন্তর্জাতিক আলোচ্যসূচিতে অথ্যনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশের অবনতির বিষয়টি প্রথমে উপস্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ৫-১৫ জুন সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন (United Nations Conference of the Human Environment)- এ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক বিশ্ব কমিশণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কাছে এ কমিশনের ১৯৮৭ সালের প্রতিবেদই উন্মক্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিকল্প পথ হিসেবে টেকসই উন্নয়নের ধারণা উপস্থাপিত হয়। এ প্রতিবেদন বিবেচনা করে সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নযন সম্মেলন আহবান করে।
১৯৯২ এর ইউএনসিইডি-তে রিও ঘোষনায় টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য মোট ২৭টি নীতিমালার অনুমোদন করা হয়। ২০০২ সালের ২৬ আগষ্ট ৪ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্যিকার জোহনসর্বাগে অনুষ্ঠিত বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন সম্মেলনে (World summit on sustainable Development-WSSD) রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা এজেন্ডা ২১ বর্ণিত টেকসই উন্নয়নের নীতি এবং অন্যান্য বিধিমালার বিষয়ে পুনরায় ঐক্যমত্য হয়। সম্মেলনে মোট ৩৭টি ঘোষণার কথা বলা হয়। সিউলে ২০০৫ এ অনুষ্ঠিত “এশিয়া ওপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরিবেশ ও উন্নয়ন শীর্ষক পঞ্চম মিনিষ্টেরিয়াল কনফারেন্স মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষাণা গৃহীগ হয়, যেখানে পরিবেশগগ ভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (সবুজ প্রবৃদ্ধি) অর্জনের কর্মকৌশলের ওপর আলোকপাত করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন