ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর কালরাত্রী আজ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যার পরে প্রায় পৌঁনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় সিডর ১০টি জেলাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ে প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা কম হলেও সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসবে যা ১৬ হাজার কোটি বলে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জানিয়েছিল। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩ সহস্রাধিক। তবে আরো প্রায় দু’হাজার নিখোঁজের আর সন্ধান মেলেনি।
আবহাওয়া দফতর ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ’ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ শনাক্ত করে। পরে তা ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হয়। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গল-হাড়িয়াভাঙ্গা উপকূল সোজা অগ্রসর হয়। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। ঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ উত্তরমুখী থেকে উত্তর-পূর্বমুখী হতে শুরু করে।
সন্ধ্যা ৬টার পরেই ঝড়টি উত্তর-পূর্বমুখী হয়ে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে মূল ভূখণ্ডে অগ্রসর হতে শুরু করে। এসময় সিডরের গতি ছিল প্রায় পৌঁনে ৩শ’ কিলোমিটার। ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ’ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক দীর্ঘ। হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল পর্যন্ত প্রায় সমান তীব্রতায় তাণ্ডব চালায় সিডর। বরিশাল মহানগরীতেও ঝড়টির তীব্রতা ছিল ২২৪ কিলোমিটার। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের বিভিষিকা অব্যাহত ছিল। ঝড়ের সাথে ২০-২৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ ও ফসলী জমি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় সিডর দেশের ৩০টি জেলায় কম-বেশি আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ’ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকারি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল ২০ লাখেরও বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় পৌঁনে ১ কোটি। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জন নিখোঁজের কথা বলা হলেও নিখোঁজের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।
সিডরের তাণ্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির মৃত্যু ঘটে।
পরিবেশবিদদের মতে, সিডরে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ হতে পারত, যদি উপকূলীয় সোয়া দু’লাখ হেক্টরের বিশাল সবুজ বেষ্টনী ও পরিকল্পিত বনায়ন না থাকত। পাশাপাশি প্রকৃতির অপার দান সুন্দরবন সে রাতে সিডরকে বুক পেতে মোকাবেলা করে। উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচি ও সবুজ বেষ্টনীর লাখ লাখ গাছ ছাড়াও সাধারণ মানুষের প্রায় ১ কোটি গাছ মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল।
এছাড়াও উপকূলীয় এলাকার প্রায় পৌঁনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১৮শ’ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১,৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শ’টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন