দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন প্রথমত বিরোধীদলের আন্দোলন দমনে অতঃপর সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলায় ব্যস্ত, তখন মাদক চোরাচালানিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জঙ্গি দমনে পুলিশের ব্যস্ততার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযান বন্ধ থাকার সুযোগ গ্রহণ করছে মাদক সিন্ডিকেট। এর মধ্যেও মাঝে মধ্যেই ইয়াবার বড় বড় চালান ধরা পড়ছে সীমান্তরক্ষী, কোস্টগার্ড ও পুলিশের হাতে। গত একমাসে শুধুমাত্র কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় ৩টি চালানে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের হাতে প্রায় ৩ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার এসব চালান দেশে পাচার হয়ে আসা চালানের খুব সামান্য অংশ মাত্র। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বরাতে বলা হয়েছে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ে সমাজে মাদকের বেচাকেনা ও ব্যবহার তার চেয়ে কয়েকশ’ গুণ বেশী। এক সময় দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন আসতো। এসব মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে দেশের লাখ লাখ তরুণের স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস হয়েছে। ফেন্সিডিলসহ সে সব মাদকের স্রোত এখনো বন্ধ হয়নি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নেশার সর্বনাশা ড্রাগ ইয়াবা টেবলেট। প্রধানত মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা রাজধানী ঢাকা শহর থেকে শুরু করে প্রতিটি বিভাগীয়, জেলা শহর হয়ে গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে।
সারাদেশ মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। শহর ও গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি জনপদে যুব সমাজ এবং উঠতি বয়েসী কিশোর-তরুণদের এক বিরাট অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বা তাদের ম্যানেজ করে অথবা তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাদক চোরাচালান চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। একদিকে সীমান্তে আমাদের বিজিবি মাদকের চোরাচালান বন্ধে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে পুলিশ বাহিনী মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেনা। তারা মাদক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন এবং সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানেই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। অথচ মাদকের ছোবলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের চেয়েও অনেক বড় হুমকি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কোন কোন পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত এমন অভিযোগে মাদকসহ আটক হওয়ারও নজির আছে। আবার মাঠ পর্যায়ের এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্য সাধারণ মানুষের কাছে চাঁদাবাজি ও অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের পন্থা হিসেবে ইয়াবা ব্যবহার করছে। তল্লাশির নামে সুযোগ বুঝে সাধারণ পথচারীদের পকেটে দু’একটি ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে অথবা ইয়াবার মামলার ভয় দেখিয়ে ব্লাকমেইল করারও অভিযোগ আছে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গত ৫ বছরে ইয়াবা উদ্ধারের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, দেশে ইয়াবার মত মাদকের চোরাচালান ও ব্যবহার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। ২০১০ সালে যেখানে বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল ৮ লাখ ১২ হাজার পিস, সেখানে ২০১৫ সালে উদ্ধার হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার পিস। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আটককৃত মাদকের পরিমাণ দেশের অভ্যন্তরে চলে আসা মাদকের খুব সামান্য অংশ। সীমান্তরক্ষী ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বানের পানির মত ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে এবং আমাদের তরুণ প্রজন্ম তা’র নেশায় আসক্ত হচ্ছে। একজন মাদকসেবী একদিকে যেমন তার পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা, অন্যদিকে সে তার মানবিক বিচারবোধ হারিয়ে যে কোন ধরনের অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের সাথে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অপরাধজগত ও অবৈধ অস্ত্রব্যবসায়ীদের নিবিড় যোগাযোগ থাকে। এমনকি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সাথেও মাদকের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। নতুন প্রজন্মের মধ্যে মাদকের নেশা ধরিয়ে দিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে খুব সহজেই ধ্বংস করে দেয়া যায়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের হুমকির পাশাপাশি সর্বনাশা মাদকের ভয়াল ছোবলে আক্রান্ত। সরকার যখন জাতিকে আগামী দশকে একটি মধ্য আয়ের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তখন আমাদের নতুন প্রজন্মের লাখ লাখ সদস্য একদিকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে মাদকের করাল গ্রাসে পতিত হচ্ছে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে শুধুমাত্র জঙ্গিবাদ নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে জাতিকে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। লক্ষ্য অর্জনে একই সঙ্গে মাদকের বিরুদ্ধেও লড়াই জোরদার করা জরুরী। সীমান্তে এবং দেশের অভ্যন্তরে কোন কোন সিন্ডিকেট মাদক চোরাচালান ও ব্যবসার সাথে জড়িত বিজিবি এবং পুলিশের তা’ অজানা নয়। মাদকের করাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে মাদক চোরাচালান ও বিপণনের পেছনের রাঘব বোয়ালদের ধরতে হবে। সেই সাথে মাদক বিরোধী জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং একটি সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন