রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রাজধানীকে দ্রুত বসবাসযোগ্য করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাজধানীতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে অন্যত্রও। করোনার সেকেন্ড ওয়েব বা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে কিনা, বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আগেই শুরু হয়েছে। এখানেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশংকা ব্যক্ত করা হয়েছে আগেই। এই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। এহেন আশংকার মধ্যেই ডেঙ্গুর বিস্তার শুরু হয়ে গেছে। এটাও একটা আতংককর রোগ। গতকাল প্রকাশিত খবর মতে, ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অন্তত ২১ ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যাদের ১৮ জনই রাজধানীর। করোনার কারণে অন্যান্য রোগের চিকিৎসার সুযোগ যখন অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে, তখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বা বিস্তার রাজধানীবাসীর জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৮৬৭ জন, যার মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। ওদিকে শীতের মধ্যে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের আশংকাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া শীতকালে কিছু রোগের প্রকোপ এমনিতেই বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ইত্যাদির কথা বলা যায়। নিউমোনিয়াও প্রাণঘাতী রোগ। শিশু ও বৃদ্ধের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ঠাণ্ডাজনিত রোগ এবং এসব করোনার লক্ষণবাহী। রাজধানীর অধিবাসীরা কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে, এ থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। স্বাস্থ্য ও সুস্থ্যতা নিয়ে তাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতংক অত্যন্ত স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, এই নগরীতে তাদের সমস্যা-সঙ্কট, দুর্যোগ-ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। এখানে মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। এসব কাজ কবে শেষ হবে, কেউ বলতে পারেনা। বছরের পর পর এই সব মেগা প্রকল্পের কারণে মানুষের অপরিসীম ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে। বেশ কিছু ফ্লাইওভার করা হয়েছে, যাদের তত্ত্বাবধান, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা লেশ মাত্র নেই। হানিফ ফ্লাইওভার, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারই নয়, প্রায় কোনো ফ্লাইওভারেই বাতি নেই। রাত্রিবেলা ফ্লাইওভারগুলো রাহাজান, ছিনতাইকারী ও দুুর্বৃত্তদের অভয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঘটে নানা অঘটন। ফলে রাত্রে যানচলাচল কমে যায়। ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তায় সৃষ্টি হয় দুবির্ষহ যানজট। ফ্লাইওভার নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনের মধ্যকার টানাটানির ফলে এদের কাক্সিক্ষত সুবিধা থেকে নগরীর অধিবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছে।

যানজট রাজধানীর নিত্য বাস্তবতা। এ কারণে ব্যক্তি পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কত ক্ষতি হয়, কী ধরনের ক্ষতি হয়, তা নিয়ে অতীতে সংবাদপত্রে বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তুু যানজট সমস্যার এতটুকু উপশম হয়নি। যানবাহনের বিপুল সংখ্যা, রাস্তার স্বল্পতা, অপ্রসারতা, ফুটপাত দখল এবং ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতার কারণে যানজটকে নিতেসঙ্গী করেই চলাচল করতে হচ্ছে নগরীর লোকদের। এটা রাজধানী বটে, তবে রাজধানীর পরিবেশ বলতে যা বুঝায়, তার প্রায় কিছুই নেই। এর রাস্তা-ফুটপাত বর্জ্যরে ভাগাড়। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ সীমাহীন। পানি নিকাশ ব্যবস্থা অপ্রতুল। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা অবধারিত। ৬৫টি খালের অধিকাংশের অস্তিত্ব নেই। যা আছে তাও সচল নয়; ময়লা আবর্জনার নিশ্চিত গন্তব্য। চারপাশের নদ-নদী দখল ও দূষণে বেহাল। খাল ও নদ-নদী উদ্ধার, সংস্কার ও স্রোতবাহী করা এবং সুষ্ঠু বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিশ্চিত করা গেলে রাজধানীর পরিবেশ অনেকটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্নত হয়ে যেতো। বায়ূদূষণ ও শব্দদূষণের দিক দিয়ে ঢাকা বিশ্বের রাজধানীগুলোর মধ্যে শীর্ষে। সেদিন এক রিপোর্টের বলা হয়েছে, রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশের শতকরা ৬৫ ভাগই শ্রবণসমস্যার শিকার। ঢাকার অধিবাসীদের বেশির ভাগই কনে খাটো ও শ্রবণসমস্যায় ভুগছে। বায়ুদূষণ যতটা সহনীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দূষণ ঢাকার বায়ুতে রয়েছে। বলা হয়, ঢাকার বাতাসে বিষ, যা নিত্যনিয়ত গ্রহণ করে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির কবলে পতিত হচ্ছে। বায়ুতে ধুলিদূষণ প্রতিবছরই ভয়াবহ রূপ নেয়। এবার শীতের আগেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ধুলিধূসরিত হতে দেখা যাচ্ছে। এর একটা উল্লেখযোগ কারণ হলো বিভিন্ন নির্মাণ ও সংস্কার কাজে রাস্তাঘাট, ফুটপাত ইত্যাদি কেটে-খুঁড়ে ফেলে রাখা। এখন সেসব ধুলা উৎপাদন স্থলে পরিণত হয়েছে। একটু বাতাসেই ধুলা ছড়িয়ে পড়ছে বাড়িঘরসহ সর্বত্র। ধুলা নিবারনের ব্যবস্থা অবিলম্বে না নিলে আগামীতে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

বসবাসযোগ্যতা পরিমাপ ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক যে সব সংস্থা আছে, গত কয়েক বছর ধরে একটানা তাদের পর্যবেক্ষন ও মূল্যায়নে এই তথ্য উঠে আসছে যে, ঢাকা বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে নিম্নতম অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছে। একে বস্তির নগরী, আবর্জনার নগরী, দূষণের নগরী, যানজটের নগরী বলে অভিহিত করা হয়েছে। বসবাসের অযোগ্য নগরী, এমন কি অসভ্য নগরীও বলা হয়েছে। অবশ্য এই নগরীকে বাসযোগ্য, নিরাপদ, সুশৃংখল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য, উপকরণ ও উপায় বিদ্যমান রয়েছে। যথোপযুক্ত উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিলেই এটা সম্ভব। নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও বর্জ্যমুক্ত রাখা, এর পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণসহ সব ধরনের দূষণ কমানো ও যানজট নিরসন, পরিবহনে শৃংখলা আনা রাস্তাঘাট যান ও জনের জন্য উন্মুক্ত রাখা, খাল ও নদ-নদী দখল ও দূষণমুক্ত করা, শান্তি, শৃংখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মোটেই অসম্ভব নয়। রাজধানীকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা নাগরিক সুবিধাদি দেয়া, নিরাপত্তা ও শৃংখলা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। নাগরিকদেরও এক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে। সরকার ও জনগণ একট্টা হয়েই রাজধানীকে বসবাসের উত্তম স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় মর্যাদা ও সম্মানের প্রশ্নও জড়িত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন