লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার দুর্গম বয়ারচর। চরের মাঠে ধান পাকা শুরু হয়েছে। সোনালি পাকা ধান দেখে কৃষকের মুখে হাসির বদলে ভয়ের ছাপ। কারণ প্রতিবছর তাদের পাকা ধান ডাকাতরা কেটে নিয়ে যায়। বাধা দিলেই খুন করে।
লক্ষ্মীপুর শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বয়ার চরের অবস্থান। চারপাশে মেঘনা নদীবেষ্টিত। চরের বাসিন্দারা জানায়, চরগাজী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের তিনটি পড়েছে লক্ষ্মীপুরে। বাকিগুলো নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার। হাতিয়া-সুবর্ণ চরের সংগঠিত ডাকাতদল প্রতিবছর এই চরে এসে ক্ষেতের পাকা ধানসহ অন্যান্য ফসল কেটে নিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে বাড়িঘরেও হানা দেয়। লুটপাট চালায়, নারীদের নির্যাতন করে। ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে ২০০০ সালের পর থেকে লক্ষ্মীপুরের অন্তত ১২ জন খুন হয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ বছরে নিহতরা হলেন মো. ফজলু, ছলেমান, গিয়াস উদ্দিন, আবদুল মতিন, আবুল কালাম, আশ্রাফ উদ্দিন, আবদুল খালেক, নিজাম উদ্দিন, মেহেরাজ, মো. ইসমাইল, ফখরুদ্দিন ও জাহিদ হোসেন। দক্ষিণ টুমচরের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, '২০০৩ সালে আমার স্বামী ছলেমানকে হত্যা করে হাতিয়ার ভূমিদস্যুরা। এখন তারা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি।' রামগতি উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (চরগাজীর দায়িত্বে) মো. আব্দুর রহমান বলেন, ওই চরে মৌসুমভেদে ধান, সয়াবিন, বাদাম, মরিচ ও ডাল উৎপাদন হয়।
সীমানা জটিলতা
স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৯৩৫ সাল থেকে রামগতির সঙ্গে বয়ার চরসহ দক্ষিণে মেঘনা নদীর ১০ কিলোমিটার সীমান্ত ছিল। এ চরটি একাধিকবার রামগতির ভূমি হিসেবে গেজেট প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে বয়ার চরকে নিজেদের এলাকায় বলে দাবি করে হাতিয়া প্রশাসন গেজেট প্রকাশ করে। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে লক্ষ্মীপুরের যুগ্ম জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা করা হয়। আদালত চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। ২০০৭ সালের ভোটার তালিকায় বয়ার চরে চরগাজী, চরলক্ষ্মী, চরদরবেশ, চরদক্ষিণ টুমচরসহ ছয়টি মৌজার মানুষ রামগতির চরগাজী ইউনিয়নের ৫, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার হয়। এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও সবশের্ষ ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই এলাকার বাসিন্দারা লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) সংসদীয় আসনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। বয়ার চরের প্রায় ১২ হাজার ভোটার চরগাজী ইউনিয়নের। লক্ষ্মীপুরের প্রশাসন থেকে এক বছরের জন্য লিজ নিয়ে ৩০-৩৫ বছর ধরে তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গত ১৬ অক্টোবর হাতিয়ার হরনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান মোরশেদসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ভোটার তালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে চরগাজীর দক্ষিণ টুমচর এলাকায় আসেন। এ সময় এলাকাবাসীর বাধার মুখে তাঁরা ফিরে যান। এ ছাড়া গত কয়েক মাস থেকে সার, বিধবা ভাতা, জমি দেওয়ার কথা বলে কয়েকজনের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ড) নিয়ে গেছে একটি চক্র।
নেপথ্যে সাবেক এমপি
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, দস্যুদের পেছনে নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ রয়েছে। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় থাকা দস্যুরা ওই এলাকা থেকে এসে অপকর্ম করে চলে যায়। এ ছাড়া নোয়াখালীর সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের সীমানা বিরোধ নিয়ে আদালতে মামলা চললেও এর ফায়দা লুটছেন তিনি।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর উপকূলীয় মেঘনা নদী ও রামগতির চরগাজীর কয়েকটি ওয়ার্ডে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর অনুসারীরা ত্রাস হিসেবে পরিচিত। তিনি (মোহাম্মদ আলী) নদী ও চর দখলে রাখতে বিগত দিনে জাহাঙ্গীর বাহিনী, বাশার বাহিনী, মুন্সিয়া বাহিনী, গিয়াস বাহিনী, নিজাম বাহিনী ও কালা বাহিনী গঠন করেন। এসব বাহিনী খুন, হামলা, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী নির্যাতন ও দস্যুতা চালিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য
চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) শেখ ফরিদ বলেন, 'হাতিয়ার চিহ্নিত দস্যুরা গত ১৫ বছরে স্থানীয় কিছু মতলববাজের সঙ্গে আঁতাত করে ১২ জনকে হত্যা করেছে। হত্যার শিকার অধিকাংশই আমার ওয়ার্ড দক্ষিণ টুমচর গ্রামের বাসিন্দা। দস্যুতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাদের জীবন দিতে হয়েছে। উপকূলের মানুষ এখন মুক্তি চায়।'
চরগাজী ইউপির চেয়ারম্যান মো. তাওহিদুল ইসলাম সুমন বলেন, 'দক্ষিণ টুমচর, চরদরবেশ ও চরলক্ষ্মী মৌজার বাসিন্দারা (বয়ার চর) আমার ইউনিয়নের ভোটার। ৩০-৩৫ বছর ধরে ভূমিহীন মানুষগুলো এখানে বসবাস করছে। সীমানা বিরোধের সুযোগ নিয়ে হাতিয়ার একটি প্রভাবশালী মহল ওই জমি দখলের পাঁয়তারা করছে।' বিষয়টির দ্রুত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। গতকাল শনিবার দুপুরে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, 'তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। রাজনৈতিক কারণে একটি মহল চর দখলসহ তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।' লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'আমি সরেজমিনে চরের লোকজনের কথা শুনেছি। এ নিয়ে নোয়াখালীর ডিসির সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বাস্তব প্রেক্ষাপট ও জনমতের ভিত্তিতে বিষয়টি নিরসন করতে হবে। আর যেন একটি মানুষও মারা না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি।'
নোয়াখালীর ডিসি বদরে মুনির ফেরদৌস বলেন, 'বিষয়টির সুরাহাকল্পে চট্টগ্রামে বিভাগীয় পর্যায়ের একটি সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন