শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

আহলে কোরআন : স্বরূপ ও তার জবাব

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

যুগের অগণিত ফেতনার অন্যতম একটি হলো, হাদিস অস্বীকার করা ফেতনা। এই হাদিস অস্বীকারকারীর দল নিজেদের নোংরা নখর বের করে সরাসরি রাসুল (সা.)-এর সত্ত্বা এবং হাদিসে রাসুল (সা.)-এর ওপর কঠিনভাবে আক্রমণ শুরু করেছে। কারণ হাদিস থেকে মুসলমানদেরকে দূরে সরাতে পারলে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো জলের মতো সোজা। এ কারণে তারা ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও ওয়াজ মাহফিল, সভা, ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের এই জঘন্য অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে তারা হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলছে। হাদিসের অপব্যাখ্যা করে তার মানহানি করছে। হাদিসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। তারা বলতে চায়, ইসলামের বিধিবিধান মোতাবেক জীবনযাপনের জন্য কেবল কোরআন যথেষ্ট, হাদিস মানার প্রয়োজন নেই। হাদিস বা সুন্নাহ শব্দটি তারা শুনতে চায় না। যার কারণে এরা নিজেদেরকে নাম দিয়েছে ‘আহলে কোরআন বা কোরআনের অনুসারী’। রাসুল (সা.)-এর করা ভবিষ্যদ্বাণী কতো সত্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে আজ। তিনি বলেছেন-‘জেনে রাখো! আমি কোরআনপ্রাপ্ত হয়েছি এবং তার সঙ্গে আরও অনুরূপ আরেকটি জিনিস (তা হলো হাদিস)। অচিরেই দেখা যাবে, এক লোক ভরা পেটে তার খাটের ওপর থেকে বলবে, তোমরা এই কোরআনকে আঁকড়ে ধরো। এতে যে সকল বস্তু হালাল পাবে, সেগুলোকে হালাল মনে করো, আর যেসব বস্তুকে হারাম পাবে, সেগুলোকে হারাম মনে করো।’ (আবু দাউদ : ৪৬০৪)। হাদিসটি রাসুল (সা.)-এর নবুওয়তের সত্যতার প্রমাণ বহন করে। কারণ নবুওয়তের যুগ পার হওয়ার পরপরই শিয়া ও খারেজি সম্প্রদায়ের হাত ধরে বিভিন্ন দল তৈরি হয়। তারা হাদিসের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তারা বলে, ‘কোরআনই যথেষ্ট।’ আর হাদিস ও স্ন্নুাহকে প্রত্যাখ্যান করে। উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে নতুন করে এই ভ্রান্ত মতবাদের উৎপত্তি হয়। তারপর তা পাকিস্তানে স্থান করে নেয়। এরপর ক্রমান্বয়ে তা আরও বিভিন্ন মুসলিম দেশে সংক্রমিত হতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের জমজমাট কার্যক্রম রয়েছে। এ মতের অনুসারীদের কেউ কেউ ইউরোপ-আমেরিকায় বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের এই বিষাক্ত মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। ফেসবুকে গড়ে তুলছে বড় একটি দল।
হাদিসে রাসুল (সা.) কোরআন সমর্থিত: রাসুল (সা.) চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে জাতির সাধারণ মানুষদের মতোই জীবনযাপন করতেন। আল্লাহতায়ালা তাকে নির্বাচিত করে পথভ্রষ্ট সমগ্র মানবজাতিকে সঠিক পথে আহবানের জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করলেন। শিক্ষা দিলেন কোরআন ও ইমান। তারপর দায়িত্ব দিলেন সে পথে মানুষকে আহবানের। এরশাদ হচ্ছে-‘এভাবে আমি আপনার প্রতি অহি করেছি রুহ (কোরআন) আমার নির্দেশে; আপনি তো জানতেন না কিতাব ও ইমান কি? পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো। যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে হেদায়াত করে দিই। আর আপনি অবশ্যই সরল সঠিক পথে মানুষকে আহবান করতেই থাকবেন।’ (সুরা শুরা : ৫২)। আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে আদেশ করলেন মানুষকে হেদায়াত করার। আর মানুষকে আদেশ করলেন তিনি যা বলেন, তা গ্রহণ করার। রাসুল (সা.) যা দিয়েছেন, তা-ই হাদিস। এরশাদ হচ্ছে-‘রাসুল তোমাদের যা দিয়েছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো। আর তিনি যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সুরা হাশর : ৭)। এই রাসুল আমাদেরকে যেমন কোরআন দিয়েছেন, সেই সঙ্গে কোরআনকে কিভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হবে, তাও আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক শিখিয়েছেন। আর বাস্তব জীবনের ঐ প্রয়োগটাই হচ্ছে বিদগ্ধ বিদ্বানদের ভাষায় হাদিস। কোরআনে যা নিষেধ করা হয়েছে, তার মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাসুল (সা.)-ও কিছু বিষয় নিষেধ করেছেন। যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। রাসুল (সা.)-এর আদেশ-নিষেধের কোনো দরকার না থাকলে আল্লাহতায়ালা তাঁর কথা উল্লেখ করতেন না। বলতেন- এই কোরআনে যা আছে, তোমরা তা মেনে নাও; যা নিষেধ করা হয়েছে, তা থেকে দূরে থাকো। অথচ কোরআনকে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বহু জায়গায় নির্দেশ দিয়েছেন। এ স্থানে বিশেষভাবে রাসুল (সা.)-এর প্রদান এবং নিষেধের কথা উল্লেখ করায় বোঝা যায়, তিনিও আদেশ করেন এবং নিষেধ করেন। তবে অবশ্যই তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে হয়ে থাকে। আর তাঁর এই আদেশ-নিষেধই হচ্ছে হাদিস।
মতভেদ হলে আল্লাহর কোরআন এবং রাসুল (সা.)-এর হাদিস থেকে সমাধান নিতে হবে: অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর কথা মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর কথাকেও মানতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন-‘হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করো।’ (সুরা মুহাম্মদ : ৩৩; সুরা নুর : ৫৪)। রাসুল (সা.)-এর কোনো কথা না থাকলে আলাদাভাবে তাঁর আনুগত্য করার জন্য ইতাআতের শব্দ ব্যবহারের দরকার ছিলো না। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা তাঁর এবং রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করার পাশাপাশি উলুল আমর তথা মুসলিম শাসকেরও আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-‘হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের শাসকবর্গের।’ (সুরা নিসা : ৫৯)। এখানে ইতাআতের শব্দটি যেমন আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে, একইভাবে রাসুল (সা.)-এর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্যের ক্ষেত্রে শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়নি। এর দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহর আনুগত্য যেমন বিনা বাক্য ব্যয়ে করতে হবে, অনুরূপ রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যও। কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্য করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, তার কথা আল্লাহ এবং রাসুল (সা.)-এর কথার সঙ্গে মিল আছে কিনা। অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য তাঁদের আনুগত্যের মাপকাঠিতে হতে হবে। এজন্য মতভেদ বা সমস্যা দেখা দিলে সমাধান কিভাবে করতে হবে, আয়াতের পরের অংশে আল্লাহতায়ালা তা বলে দিয়েছেন-‘তোমরা কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করলে তার সমাধানের জন্য আল্লাহ এবং রাসুলের শরণাপন্ন হবে।’ এখানে আর উলুল আমরের কথা বলা হয়নি। কেননা তাদের সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়। সমাধান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) দেবেন। অর্থাৎ আল্লাহর কোরআন এবং রাসুল (সা.) নিজে। তিনি জীবদ্দশায় নিজে সমাধান দিয়েছেন, আর তাঁর মৃত্যুর পর কোরআন এবং সেই সঙ্গে তাঁর রেখে যাওয়া সমাধানসমূহ। যার অপর নাম হাদিস।
আল্লাহ যেমন ফয়সালা করেন, রাসুল (সা.)-ও তেমন করেন: কোরআনের অনেক স্থানে রাসুল (সা.)-ও নির্দেশ দেন বা ফয়সালা করেন বলে উল্লেখ রয়েছে। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন-‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল কোনো বিষয় ফয়সালা করলে কোনো ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো অধিকার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ অমান্য করবে, সে প্রকাশ্য পথ ভ্রষ্টতায় পতিত হবে।’ (সুরা আহজাব : ৩৬)। এখানে আল্লাহর ফয়সালা যেমন লঙ্ঘন করার কারোর অধিকার নেই, তেমনি রাসুল (সা.)-এর আদেশ লঙ্ঘনেরও কোনো অধিকার কারোর নেই। আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে যেমন পথভ্রষ্ট হতে হবে, তেমনি রাসুল (সা.)-এর আদেশ লঙ্ঘন করলেও একই পরিণতি হবে। রাসুল (সা.)-এর কোনো আদেশ নিষেধ না থাকলে তাঁর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা অনর্থক হয়ে যায়।
রাসুল (সা.)-এর ফয়সালা না মানলে ইমান থাকবে না: রাসুল (সা.)-এর ফয়সালা ও আদেশ-নিষেধের গুরুত্ব এতো বেশি, তা না মানলে মানুষ মুমিনই থাকবে না। এরশাদ হচ্ছে-‘তোমার পালনকর্তার কসম! সে লোক ইমানদার হবে না, যতোক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে; অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনোরকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।’ (সুরা নিসা : ৬৫)। এ আয়াতে ভাষার প্রয়োগ রূপটা লক্ষ্যণীয়- কিভাবে রাসুল (সা.)-কে সম্বোধন করা হয়েছে ‘উপস্থিত একবচন’ শব্দ ‘তোমাকে বিচারক মানবে’ এবং ‘তুমি ফয়সালা করো’ দ্বারা। আর রাসুল (সা.) যা বিচার বা ফয়সালা করেছেন, তা-ই হাদিস। রাসুল (সা.)-এর যদি কোনো ফয়সালা না থাকে বা তাঁর কথার কোনো দরকার না থাকে, তাহলে তাঁকে বিশেষভাবে সম্বোধন করে এভাবে কথা বলা অনর্থক হয়ে যায়।
আল্লাহর ন্যায় রাসুল (সা.)-ও হালাল-হারাম করেন: রাসুল (সা.) হালাল করেন এবং হারামও করেন। আল্লাহতায়ালা তাঁকে এই অনুমতি দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে-‘যারা নিরক্ষর নবী (মুহাম্মদ)-এর অনুসরণ করে, যার কথা তারা তাদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, (সেই নিরক্ষর নবী) মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয় ও অন্যায় করতে নিষেধ করে। সে তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করে দেয় এবং অপবিত্র বস্তুসমূহকে তাদের জন্য হারাম করে দেয়। আর তাদের ওপর চাপানো বোঝা ও বন্ধন হতে তাদের মুক্ত করে। অতএব যেসব লোক তার প্রতি ইমান এনেছে, তার সাহচর্য লাভ করেছে, তাকে সাহায্য করেছে এবং সেই নুরের (কোরআনের) অনুসরণ করেছে, যা তার কাছে নাজিল হয়েছে, কেবল তারাই সফলতা লাভ করেছে।’ (সুরা আরাফ : ১৫৭)। এই আয়াতও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে, রাসুল (সা.)-ও আল্লাহর নির্দেশক্রমে কিছু বিষয় হালাল করেছেন এবং কিছু হারাম করেছেন। এ আয়াতের প্রথম দিকে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণের কথা বলার পর আবার তাঁর ওপর নাজিলকৃত নুর তথা কোরআনের অনুসরণের কথা আলাদাভাবে বলা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়- কোরআনের অনুসরণ যেমন দরকার, তেমনি কোরআন প্রচারকারী রাসুল (সা.)-এর অনুসরণও দরকার। আর সেই অনুসরণই হচ্ছে তাঁর সিরাতের অনুসরণ, তাঁর জীবনীর অনুকরণ; অন্য কথায়- তাঁর হাদিসের অনুসরণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম ২৮ অক্টোবর, ২০২২, ১১:০২ এএম says : 0
আহলে কুরআন এর অনুসারীরা গোমরা ও ফিতনাবাজ
Total Reply(0)
রায়হাদ হোসেন আদনান ২৯ মার্চ, ২০২২, ৪:৩৩ পিএম says : 0
জাযাকাল্লাহু খাইরান
Total Reply(0)
SEKH OSMAN GONI ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম says : 0
জাযাকাল্লাহ খইরন।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন