মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের কারনে সকল স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ বন্ধ। স্বাভাবতই তাই শিশুরা হয়ে পরেছে ঘরবন্দি। যে শিশুদের কল- কাকলিতে সেই সাত সকালে মুখরিত হতো স্কুলের আঙ্গিনা সেই স্কুলগুলো আজ খা খা করছে। গ্রামের স্কুলগুলোতে কেউ চড়াচ্ছে ছাগল, কেউ গরু বা মহিষ, আবার অনেক বিদ্যাপিঠ একেবারেই নীরব-নিস্তব্ধ ভুতুড়ে হয়ে গেছে। করোনার কারনে পৃথিবী এভাবে বদলে যাবে আমরা কেউ ভাবিনি। সারা পৃথিবীতে ২০ নভেম্বর পালিত হয় শিশু দিবস। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি শিশু নির্যাতনের, ধর্ষণের খবর, যা খুবই উদ্বেগজনক ও সামাজিক অবক্ষয়ের নজির। আজ গৃহে বৃত্তবন্দি শিশুদের নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, করতে হবে অনেক কিছু। কারন তারাই আমাদের আগামীর কর্ণধার। যেশিশুদের সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে, নাস্তা খেয়ে স্কুল যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর বিকালে খেলাধুলা, সন্ধ্যায় আবার লেখা-পড়ার টেবিলে বসা এবং কিছুক্ষণ টিভি দেখে আবার ঘুমাতে যাওয়া ছিল দৈনন্দিন রুটিন, এসবই এখন শিশুদের কাছে বিস্মৃতপ্রায় বা একেবারেই ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে।
করোনার এই সময়ে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী অনেকটাই ঘরবন্দি হয়ে আছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী প্রায় পৌনে দুই কোটির মতো, আর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী এক কোটির উপরে।
এই ঘরবন্দি জীবন শিশুদের ওপর মানসিক চাপ সৃস্টির পাশাপাশি তাদের শারীরিক বিকাশও ব্যাহত করছে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য ও মানসিক বিশেষজ্ঞরা। আমরা শিশু চিকিৎসকরা এব্যপারে যতটুকু চেষ্টা করছি বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে তা অতি সামান্যই মনে হয়। সত্যিকার অর্থে এই শিশুদের জন্য ঘরের মধ্যে লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি আনন্দদায়ক বিভিন্ন খেলা ও সৃজনশীল বিভিন্ন কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে পরিবারকেই। একই সাথে এ অবস্থায় তাদের সাথে পরিবারের সকলের আচার-আচরন অত্যন্ত সহনশীল, সহানুভূতিশীল নরম ও কোমল হতে হবে।
এই সময়টায় সারা দিন ঘরের মধ্যে থাকা ছোট শিশুটির সাথে পিতা-মাতা, বড় ভাই বা বোনের উচিৎ খেলা করা, ছবি আঁকা শিখানো ও শিক্ষামূলক গল্প শোনানো। অনেক ঘরের অভিভাবকরা এখন বাড়তি নজর রাখছেন তাদের ছেলে-মেয়েদের ওপর তা খুবই ভালো দিক।
ঠিকভাবে লেখাপড়া করছে কি না, স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী হোমওয়ার্ক কতটুকু হচ্ছে-ইত্যাদি নানা কিছু অভিভাবকদের অবশ্যই নজর রাখতে হবে। কিন্ত শিশুদের পড়াশোনায় বেশি চাপ না দিয়ে তারা যাতে একটু বিনোদনেও সময় কাটাতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
এই সময়ে শিশুদের আনন্দদায়ক কর্মকান্ডে যুক্ত রাখতে হবে তা না হলে তাদের অধিকার খর্ব হবে। এই সময়ে শিশুদের ওপর এই বন্দি দশার প্রভাবটা বেশি। খেলাধুলা-দৌড়াদৌড়ি, এসবই শিশুদের কাজ। গৃহবন্দি থাকাটা তাদের প্রকৃতির সাথে খাপ খায় না। জোর করেই তাদের এভাবে রাখতে হয়। কিশোর-কিশোরীরা স্কুলে গেলে বন্ধুদের সাথে গল্প করে কিন্তু এ সময়টাতে তা করতে পারছে না। তাই এই সময়েশিশুদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখার পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের খবরগুলোও যেহেতু শিশুদের মাঝে বেশি ভীতির সঞ্চার করে তাই এই খবরগুলো শিশুদের পজিটিভ আকারে উপস্থাপন করতে হবে। লক্ষ্যকরলে দেখবেন চার থেকে ছয় বছর বয়সী থেকে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এর প্রভাবটা সবচাইতেবেশি। আর মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির, আতঙ্কগ্রস্থদের মধ্যে এর প্রভাবটা আরো বেশি। যাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম, তারাই বেশি মানসিকভাবে আক্রান্ত হবে। আমাদের উচিৎ হবে তাদের সাহসী করে তোলা। শিশুরা যেন নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন, বই পড়ার পাশাপাশি পরিমিত খাবার গ্রহণ করে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
শিশুদের জন্য ঘরেই বিচিত্র আয়োজন রাখলে বেশ ভালো হয়। তাদের পড়াশুনার বাইরে অন্যান্য কাজে উৎসাহ দিতে হবে। সঙ্গ দিতে হবে বড়দেরই। শিশুদের বোঝাতে হবে যে, কেন এসময়ে তাদের বাইওে যাওয়া উচিৎ না।
ইনডোর গেমস, পড়াশুনায় উৎসাহের তাগিদ দেওয়াসহ তাদের শখের বই, গল্পের বই পড়তে দিতে হবে, যাতে আনন্দ পায় তা পড়তে দিতে হবে। মা-বাবার সাথে এক সঙ্গে গান গাওয়া, ছবি আঁকার মতো কাজগুলো করতে হবে। এ সময় তাদের সাথে বাবা-মাকে বেশি সময় কাটাতে হবে, শিশুদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। শিশুদের করিডোরে, ছাদে নিয়ে হাঁটতে পারেন মা-বাবারা। শিশুদের জন্য এসময়টার উপযোগি বিকল্প আনন্দের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বিশেষ অবস্থায় অভিভাবকদের সবসময় শান্ত থেকে পরিস্থিতি সামলাতে হবে। শিশুদের আগে বোঝাতেহবে কী কারণে তারা বাসায় আছে? শিশু যে বয়সী সেই হিসেবে তাকে বাস্তবতাটা বোঝাতে হবে। তাকে একটি রুটিন করে দিতে হবে, যেভাবে সে চলবে। সেখানে অবশ্যই বৈচিত্র থাকতে হবে। বাসার মধ্যে যদি আমরা একটা কর্নার করে দেই তাদের জন্য, যে এটা তোমার স্কুল, এটা তোমার খেলার জায়গা এই সময়টায় তুমি এ কাজটা করবে- এগুলো শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তবে শিশুদের ওপর কোনো কাজ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তারা যদি গান গাইতে চায়, ছবি আঁকতে চায়, গল্পের বই পড়তে চায় সেগুলো রুটিনের মধ্যে এনে দিতে হবে। শুধু তাকে বলে দিলেই হবে না, মা-বাবার তাকে সঙ্গও দিতে হবে। তার বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে কানেক্ট করিয়ে দেওয়া যেতে পারে অনলাইনে। শিশুদের সৃজনশীলতা বাড়িয়ে আনন্দময় পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেওয়া এ সময়ে খুবই জরুরী । আগে নিজেকে শান্তহতে হবে। আমরা নিজেরাই তো অস্থির। সেটি হলে আমাদের অস্থিরতাটা ওদের মধ্যে চলে যাবে। অনেক বাবা-মা অফিসের কাজটা এখন বাসায় থেকে করছে, এটাও শিশুদের বোঝানো দরকার। যেহেতু অফিসে যাওয়া-আসার সময়টা কমে যাচ্ছে, তাই সে সময়টা বাবা-মাকে বাচ্চাদের সাথে কাটাতে হবে।
আজকাল বাবা-মা দুজনই ব্যস্ত থাকেন, সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। যেহেতু এখন সময় পাওয়া গেছে, তাই বেশি সময় বাচ্চাদের সাথে কাটাতে হবে যেন তাদের বন্ডিংটা আরও স্ট্রং হয়। শিশুদের পছন্দের কাজে ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি শিশুদের ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করা আর মাইন্ড ডাইভার্ট করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আজকাল শুধু পড়াশুনাই চাপিয়ে দেই বাচ্চাদের ওপর, এখন এটা করলে চলবে না।
শিশুদের টবের গাছ কিনে দিয়ে তা পরিচর্যা করার কথা বলতে পারেন অভিভাবকরা। বিভিন্ন ধরনের ফুল ও ফলের বীজ টবে লাগানো, প্রতিদিন পানি দেওয়া এবং গাছের যত্ন করার কাজে তাদের উৎসাহ দিতে হবে। বীজ থেকে কিভাবে চারা হয়, তারপর আস্তে আস্তে কিভাবে ফুল ফোটে, ফল বা সব্জী হয় তা’ দেখে স্বভাবতই ছেলেমেয়েরা আনন্দিত হবে। তাদের মধ্যে আরো গাছ লাগানোর ইচ্ছা হবে, তারা ব্যস্ত থাকবে এবং এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করবে তাদের মনে। এছাড়া, মাটি ছাড়া কিভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে শুধুমাত্র পানির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গাছ হয়, সেটাও আমরা শিশুদের নিয়ে করতে পারি। শিক্ষার সাথে সাথে আনন্দও পাবে শিশুরা।
এছাড়াও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রঙ কিনে দিয়ে ছবি আঁকা বা নতুন গল্পের বই এনে দিয়ে বই পড়াসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। শিশু অধিকার সপ্তাহ যেনো একান্ত শিশুদের হয় সেইদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। শুধুমাত্র রেডিও-টিভিতে যেন শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২০সীমাবদ্ধ না হয়, সে দিকে সবাই খেয়াল রাখতে হবে।
অধ্যাপক (ডাঃ) মনজুর হোসেন
সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি।
সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক,
ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন