শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

থ্রি হুইলারের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

২০১৫ সালের আগস্টে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রণালয় দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি হুইলার যান চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উচ্চ অদালত মহাসড়কে থ্রি হুইলার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদেশ দিয়েছিল। এসব আদেশ-নির্দেশ এবং নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও মহাসড়কে থ্রি হুইলার নামক নসিমন, করিমন, ভটভটির চলাচল বন্ধ হয়নি বা করা যায়নি। কেন করা যায়নি, এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়ছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তথাকথিত পরিবহন সংগঠন, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এবং পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর আশ্রয়-প্রশ্রয় ও দুর্নীতির কারণে। এসব নিষিদ্ধ যান চলাচল করছে, এমনকি মন্ত্রী ও এমপি’র নাম ভাঙ্গিয়ে। প্রভাবশালী চক্রের কারণে মহাসড়কে চলাচলকারি এসব বিপজ্জনক থ্রি হুইলার আজ পর্যন্ত বন্ধ করা যায়নি। এগুলো মহাসড়কে দুর্ঘটনার ভয়াবহ কারণ হয়ে রয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর যে ৫ হাজার ৫১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে তার শতকরা ১৫ ভাগই নিষিদ্ধ থ্রি হুইলারের কারণে ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের বরিকবাজার এলাকায় ধান বোঝাইকৃত একটি নসিমনে চড়ে ১৬ জন শ্রমিক ভোর ৫টার দিকে গন্তব্যে যাওয়ার পথে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে যানটি রাস্তার পাশে পুকুরে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন শ্রমিক নিহত এবং ৬ জন আহত হয়। এই যে ৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হলো এটা শুধু তাদেরই মৃত্যু নয়, এর সাথে ৯টি পরিবারও ধ্বংসের মুখে পড়ে গেল। এভাবে নিষিদ্ধ যানবাহনের কারণে প্রতিদিন বহু মানুষ যেমন নিহত হচ্ছে, তেমনি তাদের পরিবারও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউই আমলে নিচ্ছে না, থ্রি হুইলারও বন্ধ হচ্ছে না।

সড়ক-মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করে ২০১৮ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আইনের ৪৬(৪) ধারায় ত্রুটি ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন সড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। দেখা যাচ্ছে, আইন প্রণয়ন, মন্ত্রণালয় ও উচ্চ আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞাই এসব যানবাহন চলাচল ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। মহাসড়কে যে থ্রি হুইলার চলাচল করছে তা যে কেউ ইচ্ছে করলেই তৈরি করে ফেলতে পারে। তিন চাকার উপর একটি লম্বা চেসিসে সিঙ্গেল সিলিন্ডারের ডিজেল ইঞ্জিন, পাওয়ার টিলার এমনকি পানি তোলার পাম্প বসিয়ে দিব্যি এ যানটি তৈরি করা যায়। এগুলো চালাচ্ছে, অপ্রশিক্ষিত, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন লোকজন, যাদের সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে এ ধরনের থ্রি হুইলারের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এই ১০ লাখ থ্রি হুইলার সড়ক ও মহাসড়কে সাক্ষাৎ মৃত্যুযম হয়ে রয়েছে। দ্রুত গতির মহাসড়কে কোনো ধীর গতির যান বিশ্বের কোথাও চলাচল করে কিনা, আমাদের জানা নেই। কারণ, মহাসড়ক মানেই মসৃণ এবং এতে ধীরগতির যানবাহন চলাচল দূরে থাক এর সাথে আশপাশের কোনো এলাকার আন্তঃসংযোগও সড়ক থাকে না। আমাদের দেশে নামে মহাসড়ক থাকলেও তা কোনোভাবেই মহাসড়কের সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। মহাসড়কের উপর বাজার বসছে, অবৈধ দখল হচ্ছে, যেখান-সেখান থেকে এসে সরু রাস্তা মিলছে, রিকসা এবং ধীর গতির থ্রিহুইলার অবাধে চলছে। এর ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রতিদিন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আহত-নিহতের পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর জিডিপি’র ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরেই এই ক্ষতি বহাল রয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন হুঁশ হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে থ্রি হুইলারের যে শতকরা ১৫ ভাগ দায়, তা যদি পুরোপুরি সড়ক থেকে তুলে দেয়া যেত, তাহলে ১৫ ভাগ দুর্ঘটনা কমে যেত এবং অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পেত। এসব যান চলাচল বন্ধ করার ক্ষেত্রে অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, এতে গরিব মানুষের আয়-রোজগার হচ্ছে। তাই মানবিক কারণে বন্ধ করা যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলোর কারণে দুর্ঘটনায় অসংখ্য যেসব মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এটা কি মানবিকতার বাইরে? তাদের পরিবারগুলো যে পথে বসে যাচ্ছে, তা কি মানবিকতার মধ্যে পড়ে না? বরং মানবিকতার নাম ভাঙ্গিয়ে এসব যানবাহন যে তাদের অবৈধ অর্থের একটি উৎস হয়ে রয়েছে, তা কি অস্বীকার করার কোনো জো আছে?

সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ ও নিষিদ্ধ থ্রি হুইলারের কারণে প্রতিদিন মানুষের আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিশ্বের কোথাও সড়ক-মহাসড়কে এ ধরনের যানবাহন চলাচল করে না এবং এসব নির্মাণের বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তিও নেই। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সাক্ষাৎ যম হয়ে থাকা থ্রি হুইলার দেশ থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করতে হবে। এগুলো উচ্ছেদে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষকে চিরুনি অভিযান চালাতে হবে। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়ার পর রাস্তায় অভিযান চালিয়ে এসব থ্রি হুইলার তুলে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের মানবিকতা দেখানোর সুযোগ নেই। বরং সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য মানবিকতা দেখাতে হবে। সড়ক-মহাসড়কে এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব পালনরত হাইওয়ে পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না বলেই এসব থ্রি হুইলার বহাল তবিয়তে রয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদেরও তাদের এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন উচ্ছেদে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে তাদের বিরত থাকতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন