প্রথম চীনে এসেছিলাম ২০১৭ সালে দুই মাসের একটা অফিসিয়াল প্রশিক্ষণে। এক রকম সেখান থেকেই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই যে, এখানে পিএইচডি করলে মন্দ হয় না। কারণ, ওই দুই মাসে চীন সম্পর্কে ভালো ধারণা হওয়ার পাশাপাশি চীনাদের আতিথেয়তা আমাকে অনেক মুগ্ধ করেছিল। তাই দেশে ফিরে উচ্চ শিক্ষার (পিএইচডি ডিগ্রি) সুযোগ আসার পর সেটা আর মিস করিনি। ২০১৮ সালে চীন সরকারের সিএসসি স্কলারশিপ পেয়ে আমার চীনে আসার পথটা অনেক সুগম হয়। ছোট থেকেই আমরা জেনে এসেছি, চীনারা অনেক বেশি পরিশ্রমী হয়। কথাটা পুরোপুরি সত্য। এরা যে কতটা পরিশ্রমী সেটা স্বচক্ষে দেখা ছাড়া লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। ছাত্রজীবন থেকেই তাদের এই পরিশ্রমের চাকা ঘুরতে শুরু করে। চীনাদের বিশেষ করে ফুজিয়ান প্রদেশের ফুজো শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ, গবেষণা পদ্ধতি সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দৈনন্দিন জীবনকে খুবই কাছ থেকে দেখা কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের লেখা।
শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ছাত্রছাত্রী: চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। সদ্য চান্স পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের বরণ করে নেওয়ার জন্য পুরো ক্যাম্পাস সেই সময়ে নতুন সাজে সজ্জিত হয়। ভর্তির এডমিশন, ভর্তি প্রক্রিয়া, আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ সব কিছুই অনলাইনে সম্পন্ন হওয়ায় নবাগত ছাত্রছাত্রীরা একেবারে স্থায়ীভাবে থাকার জন্যই তল্পিতল্পাসহ দূরদূরান্ত থেকে ক্যাম্পাসে চলে আসে। নতুন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা এবং নিজেদের সন্তানকে অচেনা পরিবেশে রেখে শেষ মুহূর্তে সাহস যোগানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ওইদিন সব ছাত্রছাত্রীর সাথে তাদের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে আসে। আগে থেকে ছাত্রছাত্রীরা তাদের বেশিরভাগ জিনিস অনলাইনে অর্ডার করে রাখে, যাতে ক্যাম্পাসে পৌঁছেই সেগুলো হাতের কাছে পায়। সেজন্য লাগেজে নেওয়া যায় এমন ছোটখাট কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত দিনে সকল ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে হাজির হয়। ওইদিন ক্যাম্পাসের গেটে তোয়ালে, লেপ, কম্বল, বালিশ, রুম পরিষ্কারের সরঞ্জামাদিসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের অস্থায়ী দোকান বসে। তাই নতুন জায়গায় পৌঁছে ছাত্রছাত্রীদের কোন ঝামেলায় পড়তে হয় না। এছাড়াও সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা অস্থায়ী শেড বানিয়ে ক্যাম্পাসে নবাগতদের সাহায্যের জন্য সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে। পুরো ক্যাম্পাসে লাল, হলুদ, নিল রঙের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুনে ভরে যায় আর ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট স্থানে সেট করা সাউন্ড সিস্টেমগুলোতে বাজতে থাকে সুমধুর সুর। কোথাও কোথাও সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা ওইদিন প্রদর্শন করে বিভিন্ন কুজকাওয়াজ। সন্ধ্যায় থাকে নবাগতদের উদ্দেশ্যে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আতশবাজির ফোয়ারা। সবকিছু মিলিয়ে প্রায় সপ্তাহখানিক ক্যাম্পাসগুলোতে নবাগতদের সাথে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে।
ডাইনিং ভবনগুলোতে ঢুকলে অন্য দিনের চেয়ে ওইদিন সবকিছু আলাদা মনে হয়। কেননা ডাইনিংগুলোতে রান্না করা হয় সব চাইনিজ ঐতিহ্যবাহী খাবার। বৃহৎ ভূখন্ড আর সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ চীন, তাই স্থান ভেদে প্রচলিত আছে খাবারের ভিন্নতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত চীনের প্রতিটা প্রদেশের ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। নিঃসন্দেহে তাদের খাবারেও ভিন্নতা আছে, সেজন্য ওইদিনে ডাইনিংগুলো চেষ্টা করে সব প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার রাখার, যাতে করে ছাত্রছাত্রীদের সাথে তাদের অভিভাবকরাও পেটপুরে খেয়ে তৃপ্তি পেতে পারে।
ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোতে সিঙ্গেল সিটে থাকার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সৌভাগ্য হয়। তাই ক্যাম্পাসে আসার আগেই তাদের মনের ভিতর ক্যাম্পাসের সিটের অনিশ্চয়তা, র্যাগ ডে জনিত সমস্যা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক দলে নাম লেখানোর মতো কোন জটিলতা থাকে না। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রতিটা রুমে ছয় থেকে আট জনের থাকার জন্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া দুই তলা বেড বিশিষ্ট সিঙ্গেল সিটের ব্যবস্থা আছে। তবে সিনিয়রিটি বৃদ্ধি পাওয়ার সাপেক্ষে (পিএইচডি গবেষণারতরা আরও সুবিধা পায়) ভালো থেকে আরও ভালো আসনের ব্যবস্থা করা হয়। চীনা ছাত্রছাত্রীদের বেশিরভাগ আবাসিক হলগুলোতে কর্তৃপক্ষ সার্বিক সুবিধাদি যেমন এয়ারকন্ডিশন, ওয়াশিং মেশিন, কাপড় শুকানো মেশিন, প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আলমারি, টেবিল, চেয়ার, বেড ইত্যাদির সুবিধাদি দিয়ে থাকে।
বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নবাগতদের পরিচিত পর্ব শুরু: সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের ক্যাম্পাসের পরিচিতি পর্বটা শুরু হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। ছাত্রছাত্রীদের মিলিটারি পোশাক পরে কয়েকজন বিশেষ প্রশিক্ষকের উপস্থিতিতে দিনভর চলতে থাকে ছাত্রছাত্রীদের এই প্রশিক্ষণ। প্রথম দুই মাস এই প্রশিক্ষণ ছাড়া নবাগত ছাত্রছাত্রীদের সাধারণত কোনো ক্লাসে অংশগ্রহণ করা লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়মকানুন শিখানোর পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের দেশপ্রেম, নেতৃত্ব এবং পার্থিব জীবন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে কর্তৃপক্ষ এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। কোথাও কোথাও সশস্ত্র প্রশিক্ষণও চোখে পড়ে। প্রশিক্ষণে সকল ছাত্রছাত্রীকে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণসহ তাদের সেমিস্টারের নির্ধারিত বিষয়ের নম্বরের সাথে উক্ত প্রশিক্ষণের প্রদর্শিত ক্রীড়াকৌশলাদির নম্বর একত্রিত হয়। সেজন্য সেনাবাহিনীর পোশাক পরে সার্বক্ষণিক দলনেতাদের অনুসরণ করে প্রশিক্ষণ নিতে মগ্ন থাকে প্রশিক্ষণার্থী ছাত্রছাত্রীরা। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে কখনো টানা রৌদ্রের ভিতর দাঁড়িয়ে, কখনো তালে তালে শৃঙ্খলিতভাবে হেঁটে (মার্চ করে) বা বিশেষ আওয়াজ করে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের ভঙ্গিমায় চলতে দেখা যায়। এসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করলে যে কাউকেই বিচলিত হতে হবে, এটা কি মিলিটারি একাডেমি নাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
স্বাভাবিক দিনগুলো যেভাবে শুরু হয়: স্নাতক পর্যায়ের প্রায় প্রতিদিনকার ক্লাস শুরু হয় সকাল আটটায়, তাই কেউ কেউ ভোরে ঘুম থেকে উঠে হালকা ব্যায়াম সেরে নেয়। এরপর সকাল আটটা বাজার আগেই সবাই ক্লাসের পথে রওনা দেয়। ডামপ্লিং (বাষ্পে ভাপানো ময়দার রুটি) এবং স্টিম বান (ভিতরে সবজি বা মাংসের পুর দেওয়া বাষ্পে ভাপানো রুটি) চীনাদের সকালের নাস্তায় খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। ক্যান্টিন থেকে কিনে ডান হাতে একটা স্টিম বান বা ডামপ্লিং ধরে অন্য হাতে একটা কোমল পানীয়, ফলের জুস বা দুধের প্যাকেটসহ দলে দলে ক্লাস বা ল্যাবের পথে হাঁটতে হাঁটতে সকালের নাস্তার কাজ সেরে ফেলে ছাত্রছাত্রীরা। স্টিম বান বা ডামপ্লিংয়ে এক কামড় দিয়ে দুধ বা জুসে চুমুক দিতে দিতে ক্লাস বা ল্যাবে পৌঁছানর আগে পথেই ছাত্রছাত্রীদের সকালের নাস্তা শেষ হয়। স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের রুটিন একটু ভিন্ন। এদের ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষেই বেশিরভাগ তাত্তি¡ক ক্লাস শেষ হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় বর্ষের শুরু থেকে পুরোদমে ল্যাবের কাজ শুরু করে। বলে রাখা ভালো, এখানে ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক এবং পিএইচডি পর্যায়ে চার বছর এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিন বছর পড়ার সুযোগ পায়। স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের মতো সকাল আটটার দিকে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ছাত্রছাত্রীরা ল্যাবে প্রবেশ করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চালু করা সাপেক্ষে ল্যাবের কাজ শুরু করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প গুজব, আর আনন্দ ফুর্তির ভিতরে সময় দ্রুত পার হয় তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস এবং পরীক্ষার ধরন: এখানে সব জায়গাতেই তিন শিফটে ক্লাস চলতে দেখা যায়। সকাল ৮.০০টা থেকে দুপুর ১১.৩০ পর্যন্ত সকালের সেশন, বিকাল ২.০০টা থেকে ৫.২৫ পর্যন্ত বিকালের সেশন এবং সন্ধ্যা ৬.৩০টা থেকে ৮.৪৫ পর্যন্ত সন্ধ্যার সেশনে ক্লাস চলে। ক্লাসগুলো আমাদের দেশের থেকে একটু আলাদা। যেমন: প্রতিটা ক্লাসের সময় নির্ধারণ ৪৫ মিনিট করে কিন্তু একসাথে একই শিক্ষকের ৩ থেকে ৪টা করে ক্লাস থাকে (প্রদেশভেদে ভিন্ন হতে পারে)। প্রতি ৪৫ মিনিট পরে ছাত্রছাত্রীরা ৫ মিনিটের জন্য বিরতি পায় (কিছু ক্লাসের মাঝে ১৫ মিনিটও বিরতি থাকে), এরপর আবার একই কক্ষে একই শিক্ষকের উপস্থিতিতে একই ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাস চলমান থাকে। এই তিন শিফটে ক্লাসের মধ্যেও অনেক ছাত্রছাত্রীকে কিছু রুটিন কাজ করতে দেখা যায়। যেমন: ১১.৩০ এ ক্লাস শেষে যখন দুপুরের খাবার খেতে যায়, তখন অল্প সময়ের জন্য (১০ থেকে ১৫ মিনিট) তারা পিটি সেশনে অংশগ্রহণ করে। সেখানে একজন পিটি প্রশিক্ষকের উপস্থিতিতে হালকা ব্যায়ামের কাজ সেরে তবেই দুপুরের খাবার খেতে যায়।
ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সময়ানুবর্তীতা: চীনারা সর্বক্ষেত্রেই খুবই সময় সচেতন। প্রতিটা শিক্ষক ক্লাস শুরুর নির্ধারিত সময়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট আগে ক্লাসে হাজির হয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে সবকিছু প্রস্তুত করে সাউন্ড সিস্টেমসহ যাবতীয় ব্যবস্থাদি ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে ক্লাসের জন্য নির্ধারিত সময়ের সংকেত সূচক অ্যালার্ম শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অ্যালার্ম শোনার সাথে সাথেই ক্লাসের জন্য পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীরাও খুবই সময় মেনেই ক্লাসে উপস্থিত হয়। কেননা নির্ধারিত সময়ের আগে ক্লাসে উপস্থিত না হলে সেদিনকার ক্লাসের হাজিরা গণনা হয় না। এদের প্রতিটা ক্লাসের হাজিরার উপর পাঠ্যবিষয়গুলোর মূল নম্বরের ২০-২৫% বণ্টিত। এছাড়া ক্লাসে সর্বনিন্ম একটা উপস্থিতির সীমা অতিক্রম না করলে পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। এজন্য ছাত্রছাত্রীদের সচারাচার ক্লাস মিস দিতে দেখা যায় না।
এখানে বেশিরভাগ পরীক্ষা পদ্ধতি ওপেন বুক ব্যবস্থার মাধ্যমে হয়ে থাকে। অর্থাৎ পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেট ব্যবহারের পাশাপাশি যেকোন বই পুস্তকের সুবিধা নিতে পারে। কিন্তু একজন ছাত্র বা ছাত্রী অন্য কারোটা দেখে লিখতে পারবে না। সেজন্য পরীক্ষার হলগুলোতে শিক্ষকদের কড়া নজরদারি থাকে। ছাত্রছাত্রীরা খুবই ভদ্রতা বজায় রেখেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যেহেতু পরীক্ষায় বই পুস্তক দেখে লেখার সুযোগ থাকে তাই অসাদুপায় অবলম্বন করার কোনো প্রশ্ন উঠে না। পরীক্ষার আসনে বসে সব ছাত্রছাত্রী নিজের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে সেগুলো উত্তরপত্রে লেখার জন্য ব্যস্ত থাকে। পুরো পরীক্ষার হলে নিরবতা বজায় রেখে নির্ধারিত সময়ের ভিতরে পরীক্ষা শেষ করার জন্য শিক্ষকের কড়া হুঁশিয়ারি থাকে। প্রায় সববিষয়েই নির্ধারিত ক্লাস এটেন্ডেন্স, হোমওয়ার্ক, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, মিড-টার্ম-এ নাম্বার বণ্টিত থাকায় চূড়ান্ত পরীক্ষার নম্বর মোট নম্বরের ৬০-৭০% (বিষয় ভিত্তিক কমবেশি হতে পারে) হিসাব করে গণনা হয়।
ছাত্রছাত্রীদের দুপুর এবং নৈশ ভোজের চিত্র: সকাল ১১টা বাজতেই দুপুরের খাবারের জন্য সবাই প্রহর গুণতে শুরু করে। মোটামুটি তখন থেকেই ছাত্রছাত্রীরা উইচ্যাট (চীনাদের সর্বাধিক ব্যবহৃত সামজিক যোগাযোগের মাধ্যম) গ্রুপে বার্তা আদান প্রদানের মাধ্যমে চূড়ান্ত করে ফেলে দুপুরের খাবার কোথায় খাবে। হতে পারে সেটা ক্যাম্পাসের ডাইনিংয়ে কিংবা অনলাইনে অর্ডার করে। যেদিন যেটাতে মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রীর সম্মতি থাকে সেটাতেই বাকীরা সবাই সম্মতি জানায়। সবাই চেষ্টা করে দুপুর ১২টার ভিতর দুপুরের খাবার শেষ করতে। স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের দুপুরের খাবারের পরে বেশ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বিকেলের সেশনে ক্লাস শুরু হয়। এই বিরতির সময়ে সবাই নিজ নিজ আবাসিক হলে ফিরে দুপুরের ভাতঘুম সেরে আবার বিকেলের সেশনের ক্লাসে বের হয়। স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি অধ্যায়নরত ছাত্রছাত্রীরা দুপুরের খাবার থেকে ফিরে ল্যাবের ডেস্কে হালকা ভাতঘুমের কাজটা সেরে নেয়। এরপর আবার ল্যাবের কাজে মনোনিবেশ করে।
বিকাল ৫টা বাজলে ডিনারের জন্য সেই দুপুরের লাঞ্চের মতো আবার সবাকেই চিল্লাপাল্লা, হৈ হুল্লোড় করতে দেখা যায়। দলবেঁধে ডিনারের জন্য বের হয়। কিন্তু এবারের চিত্রে একটু ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। দুপুরের খাবারে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর গন্তব্য ক্যাম্পাসের ডাইনিংগুলোতে থাকলেও নৈশ ভোজের সময় কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী বেছে নেয় ক্যাম্পাসের ঠিক বাইরে অবস্থিত রেস্তোরাঁগুলোকে (কোনো কোনো ক্যাম্পাসের ভিতরেই আছে এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ)। এই রেস্তোরাঁগুলোতে ডিম, মাছ, মাংস, সবজি, সি-ফুড থেকে শুরু করে পিজ্জা বার্গারসহ সবরকমের খাবার পাওয়া যায় এবং সবখানেই বার-বি-কিউ করে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। দামও হাতের নাগালে ডাইনিংগুলোর থেকে সামান্য বেশি। সন্ধ্যায় এই রেস্তোরাঁগুলো ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা ভরপুর থাকে। খাবারের জন্য এক এক গ্রুপের জন্য বড় বড় ডাইনিং টেবিলের ব্যবস্থা আছে রেস্তোরাঁগুলোতে। সবাই শৃঙ্খলিত হয়ে বসে পেটপুরে ভোজন এবং গল্প গুজব শেষে আবার দলবেঁধে ক্যাম্পাসে ফেরে। ক্যাম্পাসের ডাইনিংগুলোতে খাবারের স্বাদের ভিন্নতা থাকায় ছাত্রছাত্রীদের বাইরে খেতে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বিশেষ কোনো উপলক্ষ যেমন কারও জন্মদিন, কারও গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হলে সে দিনগুলোতে তারা উদযাপনের জন্য বাইরের রেস্তোরাঁগুলো বেছে নেয়।
খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদন: রাতের খাবারের পরেই ক্যাম্পাসের মাঠ ছাত্রছাত্রীদের খেলায় মুখরিত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন মৌসুমে ক্যাম্পাসগুলোতে বিভিন্ন ধরনের খেলার সুযোগ করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাস্কেট বল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, লং জাম, হাই জাম এই খেলাগুলোই ছাত্রছাত্রীদের বেশি খেলতে দেখা যায়। একই দলে ছেলে মেয়ে সমানভাবে সব খেলায় অংশগ্রহণ করে। আবার ডিনারের পরে অনেকে একসাথে মিলে গল্প করতে করতে পুরো ক্যাম্পাস দৌড়ে বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রাখা ফ্রি সাইকেলে চেপে কয়েকবার রাউন্ড দিয়ে প্রতিদিনকার ব্যায়ামের কাজ শেষ করে। তবে ডিনারের পরে সবাই কমবেশি হাঁটাহাঁটি করবে এটা নিশ্চিত। ছাত্রছাত্রীদের ব্যায়াম করার জন্যও আছে অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদিতে ভরা আধুনিক জিমনেশিয়াম। সেখানেও সকাল-সন্ধ্যায় ভিড় লক্ষ করা যায়। সন্ধ্যায় বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বেশ আনন্দমুখর পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক চর্চার আসর বসে। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের গান, আবৃত্তিসহ মজার মজার কিছু পরিবেশনা চোখে পড়ে। জীবনকে উৎফুল্ল রাখার ব্যাপারে চীনারা অনেক বেশি চেষ্টা করে আর সেই চেষ্টার হাতেখড়িটাও শুরু হয় ছাত্রজীবন থেকেই এবং চলে আজীবন। ক্লাস, পরীক্ষাসহ বেশ কিছু রুটিন মাফিক কাজ থাকার সত্তে¡ও হাসি, আনন্দ, বিনোদনের ভিতর দিয়েই তাদের প্রতিদিনকার সময় কখন অতিবাহিত হয়ে যায় সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। (চলবে)
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।
ajoymondal325@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন