দিনাজপুরের হিলি সীমান্তের শূন্য রেখায় বিজিবি ও বিএসএফ’র মধ্যে রাখিবন্ধন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। খবরে জানানো হয়েছে, বিজিবি-বিএসএফ’র মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে মূলত এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বিজিবি’র সদস্যদের কপালে চন্দন টিপ ও হাতে রাখি বেঁধে মিষ্টিমুখ করান বিএসএফ’র নারী সদস্যরা। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে এ উৎসবের একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাখিবন্ধন হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় উৎসব। এটি মূলত ভারতের কিছু অংশ ও নেপালে পালন করা হয়। উত্তর ভারত ও নেপালের পার্বত্য অঞ্চলের ব্রাহ্মণ ও বৈদিক ব্রাহ্মণদের মধ্যে এ উৎসব বেশি প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবেও এ উৎসবের প্রচলন রয়েছে। তাদের বিশ্বাস, রাখিবন্ধনের মাধ্যমে ভাই ও বোনের মধ্যে ভালবাসা এবং কর্তব্য বৃদ্ধি পায়। এটি সুরক্ষা বন্ধন হিসেবেও পরিচিত। মুসলমানরা জন্মগতভাবেই একে অপরের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ এবং এক ভাই বা বোন আরেক ভাই বা বোনকে সুরক্ষা দেয়া তার পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে। যে সম্পর্ক জন্মগতভাবেই সার্বজনীন এবং রক্তের সম্পর্ক না হলেও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের মধ্যে আবর্তিত সে সম্পর্ক স্থাপনে আলাদাভাবে কোনো উৎসব পালনের প্রয়োজন নেই। ফলে আমাদের দেশে বা মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করার নির্দিষ্ট উৎসব পালন করার দরকার হয় না।
যার যার ধর্মীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি তারা পালন করতেই পারে। এটা স্ব স্ব ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপার। তবে কারো ধর্মীয় সংস্কৃতি অন্য কারো উপর চাপিয়ে দেয়া বা চাপিয়ে দেয়ার আয়োজন করা দৃষ্টিকটুই বটে। তার উপর সেটি যদি হয় একতরফা। বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে রাখিবন্ধন উৎসবটি অনেকটা আরোপিত বলেই প্রতীয়মান হয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের বিজিবিও তা সানন্দে গ্রহণ করেছে। এটা বিজাতীয় একটি সংস্কৃতিকে স্বাগত জানানোরই নামান্তর। মনে হতে পারে, এখন স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে বিজাতীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি সীমান্ত দিয়েও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ প্রবাহের কারণে ইতোমধ্যে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো নিষিদ্ধ করে রেখেছে। এতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, পরিকল্পিতভাবেই আমাদের দেশে হিন্দু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও বিকাশ ঘটানো হচ্ছে। বিএসএফ তাদের ধর্মীয় রীতি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী রাখিবন্ধন উৎসব পালন করুক, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। তবে যখন আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে নিয়ে এধরনের উৎসব আয়োজন করা হয়, তখন খটকা লাগা স্বাভাবিক। আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, বিএসএফ সীমান্তে কীভাবে বাংলাদেশীদের গুলি ও নির্যাতন করে মারছে। জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রশ্রয়ে সীমান্ত দিয়ে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালানের মতো ঘটনা ঘটছে। তারা একদিকে বাংলাদেশীদের হত্যা ও নির্যাতন করবে, অন্যদিকে ভ্রাতৃত্বের উৎসব করবে, এ ধরনের আচরণকে প্রহসন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! বাংলাদেশের জনগণ বরাবরই দেখে আসছে, ভারত আমাদের সাথে কী বিরূপ আচরণ করে চলেছে। তার আচার-আচরণে সবসময়ই দাদাগিরি এবং দাবিয়ে রাখার এক ধরনের আচরণ ফুটে উঠেছে। এই দাদাগিরি করেই আমাদের কাছে তার যত চাওয়া-পাওয়া ও আবদার আদায় করে নিয়েছে। ট্রানজিটের নামে করিডোর, তার স্বার্থের অনুকূল ব্যবসা-বাণিজ্যসহ হেন কোনো বিষয় নেই, যা নেয়নি। এমনকি মানবিকতার কথা বলে বিনামাশুলে বাংলাদেশের উপর দিয়ে খাদ্যপণ্যসহ ভারি শিল্পের মালামাল পরিবহনের আবদারও আদায় করে নিয়েছে। ভারত তার প্রয়োজনীয় সব দাবী পূরণে একচুলও ছাড় দেয়নি এবং এক্ষেত্রে তার ন্যূনতম ভ্রাতৃত্বের পরিচয়ও মেলেনি। বিনিময়ে সীমান্তে বিএসএফ’র গুলি ও নির্যাতন ছাড়া বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। শত কাঠখড় পুড়িয়েও জীবনমরণ সমস্যা হয়ে উঠা পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি ভারত মীমাংসা করেনি। এক তিস্তা চুক্তি করা নিয়ে কত যে কথা এবং টালবাহানা দেখা গেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শেষ পর্যন্ত এ চুক্তি হিমাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারতের এমন বৈরী আচরণের মধ্যে যখন বিএসএফ তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির উৎসব নিয়ে হাজির হয় এবং তাতে আমাদের বিজিবি অংশগ্রহণ করে, তখন দুঃখের সীমা থাকে না। এই অসচেতনতার দায় বিজিবি প্রধান ও সংশ্লিষ্টরা এড়িয়ে যেতে পারেন না।
রাখিবন্ধন যেমন আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে নেই, তেমনি তা আমাদের দেশের মানুষের কাছেও গ্রহণীয় নয়। এমনকি হিন্দু ধর্মের সবার মধ্যেও এর চর্চা নেই। ফলে আমাদের দেশের চিরায়ত ধর্মীয় সংস্কৃতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এতে অংশগ্রহণ করা সমীচীন হয়েছে বলে দেশের মানুষের মনে করার কারণ নেই। দেশের মানুষ যদি মনে করে, আমাদের উপর হিন্দুয়ানী বা বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার এটি একটি অপকৌশল এবং তা অবলীলায় বিজিবি গ্রহণ করেছে, তবে তা অমূলক হবে না। এমন যদি হতো, নেপাল ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে এ উৎসব হয়েছে, তাহলে তা স্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান হতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সদ্ভাব থাকা এবং আশা করা স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে ফুল, মিষ্টি বিতরণ হতে পারে। সদ্ভাব দেখানোর জন্য এক দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি আরেক দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভ্রাতৃত্ব প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিজস্ব রীতি-নীতি রয়েছে। তবে মুসলমানরা কখনোই এক হাতে অস্ত্র তাক করে, আরেক হাতে ফুল দেয়ার মতলবী ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন