দেশের সব সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৬ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ফলাফলের প্রায় সব সূচকেই গত বছরের তুলনায় অগ্রগতি হয়েছে। গত বছরের চেয়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা লক্ষাধিক বৃদ্ধির পাশাপাশি পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও বেড়েছে। একজনও পাস করেনি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমলেও শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। গতবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১১৩৩টি, এবার ৮৪৮টি এবং শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩৫টি, এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫টিতে। সব সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৩ হাজার ৬৪০ জন, পাস করেছে ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ জন। পাসের গড় হার ৭৪ দশমিক ৭০ এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। মোটামুটি এই হচ্ছে এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত উপাত্ত। অংশগ্রহণ, পাসের হার, উচ্চতর গ্রেডবৃদ্ধির এই ফলাফল ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারো সব শিক্ষা বোর্ডকে টপকে পাসের সর্বোচ্চ হার অক্ষুণœ রাখতে সক্ষম হয়েছে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড। মাদরাসা বোর্ডের পাসের হার ৮৮.১৯ ভাগ। অবহেলিত এবং সুবিধাবঞ্চিত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এই ফলাফলই বলে দেয় দেশের মাদারাসাগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত বেশি নিরলস ও পরিশ্রমী।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার স্তরে পা রাখতে যাওয়া দেশের বিশাল সম্ভাবনাময় এই শিক্ষার্থীরা আমাদের জন্য অন্যতম ভরসার স্থল। এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ একদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের শিকার, অন্যদিকে মাদকের ভয়াল ছোবলে আক্রান্ত হয়ে দিশাহারা। এরই মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রায় ৯ লাখ শিক্ষার্থী দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পদার্পণ করতে চলেছে। সকল বাধা ও প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে জাতির সামনে এগিয়ে চলার পথরেখা এখানেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে অনেক বৈষম্য, বিভ্রান্তি এবং ত্রুটি আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এরপরও উচ্চশিক্ষার দ্বারে পৌঁছানো শিক্ষার্থীর এই ক্রমবর্ধমান হার আমাদের আরো আশাবাদী করে তোলে। দেশে বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় জাতিকে আশাবাদী হয়ে ওঠার মতো ফলাফল উপহার দেয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
পরীক্ষায় পাস এবং উচ্চতর জিপিএ’র হার বৃদ্ধি নিশ্চিত করাই একটি শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শিক্ষার কাক্সিক্ষত মান নিশ্চিত করা। মাতৃভাষা, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত, আধুনিক ফলিত বিজ্ঞান, ইংরেজিসহ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার একটি সুসমন্বয় ছাড়া শিক্ষার কাক্সিক্ষত মান অর্জন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি, কারিকুলাম এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থায় যে বড় ধরেেনর ঘাটতি রয়ে গেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। পক্ষান্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ী মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাসহ মাদরাসাগুলো নানাভাবে অবহেলার শিকার হওয়ার পরও সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যসূচির বাইরে আরবি ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এরা অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়ার পরও তারা উচ্চ শিক্ষাঙ্গনেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হচ্ছে। মাদরাসায় পড়েও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হচ্ছেন। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে ধর্মীয় শিক্ষা ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদিতে মাদরাসা শিক্ষিতরা বিকল্পহীন অবদানই শুধু রাখছে না, তারা সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। এমনকি কওমী মাদরাসার শিক্ষায় শিক্ষিত লাখ লাখ ওলামা সরকারি স্বীকৃতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই অত্যন্ত সীমিত আয়ে সৎ জীবনযাপনের অনন্য নজির হয়ে আছেন। আমাদের সমাজ যখন সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকের ছোবলে বিপর্যস্ত, তখন মাদরাসা শিক্ষিতরা এসব অনৈতিকতা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে মাদরাসা (আলিম) শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সাফল্য থেকে মাদরাসা শিক্ষার প্রতি অ্যালার্জিক তথাকথিত প্রগতিশীল সমালোচকদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। প্রতি বছর উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। এবারো পাস করাদের জন্য আসন সঙ্কট হবে না বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে মেধাবী। একটি উন্নত, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত, দক্ষ ও নৈতিক মানসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বিশেষত মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু পাসের হার নয়, শিক্ষার মানের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন