শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ফিরে দেখা রবার্ট ফিস্ক : সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাদের বিপরীতে শান্তির সৈনিক

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

পেশাগত ন্যায়নিষ্ঠতা, সততা ও দক্ষতার মধ্য দিয়ে যে কোনো পেশার মানুষ সমাজে চিরস্থায়ী শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে স্থানটি আরো উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত হয়ে উঠতে পারে। বৃটিশ সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রবার্ট ফিস্ক এভাবেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। গত ৩০ অক্টোবর আয়ারল্যান্ডে ডাবলিনের একটি হাসপাতালে ৭৪ বছর বয়েসে আকষ্মিক মৃত্যু হয় ফিস্কের। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর কালিমা লেপনকারী ক্ষমতাদর্পী শাসকরা যখন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ হাসিল করতে মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য ও প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজ ব্যবহার করে একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছেন, যখন মুক্ত গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাকে সাঁজোয়া গাড়ির পেছনে থাকা এম্বেডেড জার্নালিজমে পরিনত করা হয়েছে, তখন পশ্চিমা দুনিয়ার যে ক’জন সাহসী অনুসন্ধানি সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক সত্যানুসন্ধানের পথ দেখিয়েছেন, তাদের মধ্যে রর্বাট ফিস্ক অন্যতম। সেই আশি ও নব্বইয়ের দশকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক সংকট ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধের ঘটনাগুলো নিয়ে তাঁর মধ্য বয়েসের তারুণ্যদীপ্ত সাহসী উচ্চারণে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। প্রবল, সর্বপ্লাবি কর্পোরেট প্রপাগান্ডার বিপরীতে দাঁিড়য়ে জায়নবাদী ইসরাইল এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাজ চেহারা অনুসন্ধানী রিপোর্টের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে বার বার তুলে ধরেছিলেন তিনি। রবার্ট ফিস্কের মৃত্যু পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের কর্পোরেট ওয়ার মঙ্গারিংয়ের বিপক্ষে একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধের বিপক্ষে মানবতার কন্ঠম্বরকে উচ্চকিত করে তোলা এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত জনপদের মানুষের সংক্ষোভ ও সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরার মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন ফিস্ক।

রবার্ট ফিস্কের বাবা বিল ফিস্ক মিত্রশক্তির পক্ষে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধে নিজ কমান্ডের নির্দেশ অমান্য করায় বিল ফিস্ককে সামরিক আদালতের সাজা ভোগ করতে হয়েছিল। নিজ দলের এক সৈন্যকে গুলি করার হুকুম তিনি অমান্য করেছিলেন। পিতার যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাকে সমর্থন না করলেও সেই কর্মকে রবার্ট ফিস্ক সমর্থন জানিয়ে লিখেছিলেন, এটিই তার পিতার প্রতি তার সমর্থনের একমাত্র নৈতিক ভিত্তি। মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা আগ্রাসী যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেই শূন্যতা পূরণে গত চার দশক ধরে অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে গেছেন রবার্ট ফিস্ক। সত্তুরের দশকের শুরুতে দ্য টাইমস পত্রিকার বেলফাস্ট প্রতিনিধি হিসেবে পর্তুগালের কারনেশন রেভ্যুলেশন নিয়ে তিনি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন তা ছিল অভূতপূর্ব। এরপর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি হিসেবে তার সাংবাদিকতা জীবনের আসল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৭৬ সাল থেকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বসবাস করে ইরানে আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে সংঘটিত ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব, শাবরা শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরাইলী মিলিশিয়া হামলায় সহস্রাধিক ফিলিস্তিনির প্রাণহানির ঘটনা এবং পরবর্তী প্রতিটি যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তুলে আনার পেছনে রবার্ট ফিস্ক এক নির্ভীক যোদ্ধার মত কাজ করেছেন। এম্বেডেড জার্নালিজমের ছত্রছায়া পরিত্যাগ করে স্বাধীন সাংবাদিকতার কমিটমেন্ট থেকে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন ফিস্ক। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে লিসবন-বেলফাস্ট থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বৈরুত, তেহরান, দামাস্কাস, কাবুল, বাগদাদ, আলজিয়ার্স, সারায়েভো, ত্রিপলি পর্যন্ত গত চার দশকের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ-সংঘাত ও বিপ্লবের অন্তর্গত চেতনা ও বেদনাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। ঔপনিবেশিকোত্তর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কদর্য চেহারাটি তুলে ধরতে আরো বেশ কয়েকজন পশ্চিমা সাংবাদিক লেখক-বিশ্লেষক কাজ করলেও তার মত করে এমন নিবেদিত হয়ে আর কেউ এগিয়ে আসেনি।

মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্যকে উপজীব্য করে কর্পোরেট মিডিয়ার পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডার মূল এজেন্ডাই হচ্ছে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের অনুকূলে রিজিম চেঞ্জ বা ক্ষমতার পরিবর্তন। সামরিক আগ্রাসনকে জায়েজ করতে এবং নিজ দেশে জনমত ধরে রাখতে এসব মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে থাকে পশ্চিমা শাসকরা। ইরাকের কুয়েত হামলাকে কেন্দ্র করে প্রথম গাল্ফ ওয়ার থেকে শুরু করে সাদ্দাম হোসেনের তথাকথিত গণবিদ্ধংসী ক্ষেপনাস্ত্রের মজুদ থাকার মিথ্যা তথ্য, আফগানিস্তানে আলকায়েদা নেটওয়ার্কের মিথ্যা তথ্য, মুয়াম্মার গাদ্দাফির পারমানবিক প্রকল্পের অতিরঞ্জিত তথ্য এবং ইরানের পারমানবিক জ্বালানি প্রকল্প নিয়ে তিন দশক ধরে পানি ঘোলা করার সর্বাত্মক প্রয়াসের বিপরীতে সত্য উৎঘাটনের প্রয়াস খুবই ক্ষীণ ছিল। বৃটেনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে রবার্ট ফিস্কের সত্যানুসন্ধানি প্রতিবেদনগুলো তাঁকে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছে। জীবদ্দশায়ই তিনি বৃটেনের সবচেয়ে কীর্তিমান ও খ্যাতিমান করেসপন্ডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। মৃত্যুর পর সে উচ্চতায় উজ্জ্বল দ্যুতিময় তারকা হয়ে উঠেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নেয়া সৈনিক পিতা বিল ফিস্ক সন্তানের চেতনায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের বীজ বপণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি শান্তিবাদী ছিলেন তবে নিজেই যুদ্ধবাজদের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরতে নিজের কলম ও ক্যামেরাকে ভয়ঙ্কর অস্ত্রে পরিনত করেছিলেন। যুদ্ধের জয়পরাজয় নিশ্চিত না হলেও ফিস্কের কলম ও ক্যামেরার ঝলকানিতে কর্পোরেট মিডিয়ার এম্বেডেড জার্নালিজমের সৃষ্ট অনেক অন্ধকার দূরিভূত হয়েছিল। সাংবাদিকতার পেশাটাকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করার সুমহান দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন রবার্ট ফিস্ক। চল্লিশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক পটপরিক্রমা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হতে পেরেছিলেন। এ কারণেই সাম্রাজ্যবাদি পশ্চিমা জগতে মোস্ট ডেঞ্জারাস ও ওয়ান্টেড ব্যক্তি, আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সব আড়াল ও গোপনীয়তা ভেঙ্গে কাছাকাছি পৌছতে পেরেছিলেন। ওসামা বিন লাদেনের তিনটি সাক্ষাৎকারের মধ্যে প্রথমটি ফিস্ক প্রথমটি নিয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে, নাইন-ইলেভেনের ৭ বছর আগে তখনো আলকায়েদা বা ওসামা বিন লাদেন বিশ্বের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেনি। আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেনের কর্মতৎপরতাকে ঘিরে ভবিষ্যতে বড় ইস্যু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তিনি কি সে সময়েই আঁচ করতে পেরেছিলেন? একজন পশ্চিমা সাংবাদিক হয়ে আল-কায়েদা নেতার কাছাকাছি পৌছে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রমানীত হয়, সত্য উৎঘাটনে এবং পেশাগত কমিটমেন্ট রক্ষায় তিনি কতটা নিবেদিত ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে, আরবী ভাষাটা খুব ভালোভাবে রপ্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ফিলিস্তিনের সংগ্রাম এবং দশকের পর দশক ধরে জায়নবাদি আগ্রাসনের বৃত্তান্ত তিনি অনবরত পশ্চিমা গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

গত চার দশকে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘটিত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নেপথ্য কার্যকারণ এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা সম্পর্কে নিজের বিশ্লেষণী দক্ষতায় মুক্তিকামি মানুষের জন্য চিন্তাসুত্র ধরিয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেই একটি থিঙ্কট্যাঙ্কের ভ’মিকা পালন করেছেন। তবে বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে দখলদারিত্ব ও ডাকাতির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কোনো রকম ইতিবাচক পরিবর্তনের তাগিদ দেখা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয় ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থায় একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা সৃষ্টির কারণে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এজেন্ডাগুলো জনমত ও জবাবদিহিতার বাইরে চলে গেছে। এরপর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের একনিষ্ঠ মনোযোগ মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের দিকে বর্তাচ্ছে। শুধু ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি হিসেবে নয়, মুক্তবুদ্ধি ও মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রবার্ট ফিস্ক এখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতন্দ্র পাহারাদারের মত কাজ করে গেছেন। সীমান্তযুদ্ধের প্রতিকুল বাস্তবতায় তিনি বিভিন্ন সময়ে শারিরীক আঘাত ও নিগ্রহের শিকার হলেও রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর সম্মুখীন খুব একটা হননি। এখানেই রবার্ট ফিস্ক বা জন পিলজারদের সাথে তৃতীয় বিশ্বের সাংবাদিকদের কর্মক্ষেত্রের পার্থক্য ধরা পড়ে। পশ্চিমা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদি চেহারা উন্মেচিত করেও তারা নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে করতে পারছেন, আর জামাল খাশোগির মত সাংবাদিক দেশান্তরি হয়েও শাসকের নিষ্ঠুর থাবা থেকে বাঁচতে পারেননি। তুরস্কের সউদি কনস্যুলেট ভবনে সউদি-মার্কিন নাগরিক জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের পর রর্বাট ফিস্ক যে কলাম লিখেছিলেন, ‘জামাল খাশোগি আন্ডারস্টুড দ্য পাওয়ার, দ্যাটস হোয়াই হি ইজ ডেড’। জামাল খাশোগি সউদি শাসকদের ভালমত জানতেন এবং তাদের ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলেই তাঁকে মরতে হয়েছে। এ জন্য শুধু সউদী শাসকদের উপরই দোষ চাপাননি পাশাপাশি পশ্চিমা শাসকরাও এর জন্য দায়ী বলে ফিস্ক মন্তব্য করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি নিবন্ধে রবার্ট ফিস্ক জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের পর কানাডা সরকারের দৃঢ় প্রতিক্রিয়াকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রবার্ট ফিস্ক তার নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘মানি ইজ অলওয়েজ উইনস ওভার মার্ডার: ট্রডো উডনট স্টপ টুয়েল্ভ বিলিয়ন ডলার সউদি আর্মস সেল’। সত্যিই তাই, সউদি আরবে নির্মম বল প্রয়োগে শিয়া নাগরিকদের আন্দোলন দমনের নামে অসংখ্য হত্যাকান্ড, জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড বা রিয়াদ থেকে কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের মত অমানবিকও অপ্রীতির ঘটনাবলীর পরও জাস্টিন ট্রুডো ২০১৪ সালের সউদি অস্ত্রচুক্তিকে বাতিল করতে পারেননি।

সত্যনিষ্ঠ, সাহসী ও মুক্ত সাংবাদিকতা বিশ্ব সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও সম্পদ। বাণিজ্য, অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়ণের যুগে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে একদেশদর্শিভাবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এ অর্থে রবার্ট ফিস্ক, জন পিলজার, মারগুয়েরিট হিগিন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, নোয়াম চমস্কি, মার্থা গেলহর্ন,জনাথন কুক বা আন্দ্রে ভিচেকের মত সাংবাদিক-সমাজতাত্তি¡করা বিশ্ব সভ্যতার মহামূল্যবান সম্পদ। এদের একজন হারিয়ে গেলে বিশ্ব সভ্যতা অনেক বড় হারায়। তারা মুক্তবুদ্ধি, মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয়, নানাভাবে শৃঙ্খলিত গণমাধ্যম ও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অধ:পতিত আমাদের মাৎস্যন্যায়ের সমাজে রবার্ট ফিস্কদের মত সাংবাদিকদের কর্মময় জীবন কারো কারো জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। গদ মাসের তিরিশ তারিখে ফিস্ক মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক সমাজের সংগঠন ও প্রতিনিধিরা রবার্ট ফিস্কের চলে যাওয়াকে যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলেই মনে করেননি। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামমগ মধ্যপ্রাচ্যের উপর পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একজন রবার্ট ফিস্ক যে যুদ্ধটা চালিয়ে গেলেন, তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশের দাবি রাখে। চলমান বিশ্বে পরাশক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে লুন্ঠন ও যুদ্ধবাদী অর্থনীতি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মূল ক্ষেত্রে পরিনত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে নিও ওয়ার্ল্ড অর্ডারের নীল নকশায় ফিলিস্তিনি আরবদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করে তাদের জমি দখল করে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ রাষ্ট্রটিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা। এ বিষয়টিকেই নিজের সাংবাদিক জীবনের প্রধান এসাইনমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ফিস্ক।

ইসরাইলী জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ক্রমে এশিয়ার জনবহুল দেশগুলোতেও বিস্তৃত হচ্ছে। চীনের সাথে ভারতের সামরিক-কূটনৈতিক সংঘাতে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ তৎপরতা না থাকলেও পাক-ভারত সংঘাতে বরাবরই ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক বাহিনী ভারতের পক্ষে কাজ করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আঞ্চলিক সংহতি ও নিরাপত্তা জোরদার করতে সক্ষম হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলো অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। প্রায় চার দশক আগে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারতের অনাগ্রহ ও আধিপত্য বাদী নীতির কারণে তা এখনো সফল হয়নি। ভারত পাকিস্তান প্রায়শ মুখোমুখী সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমারা নিরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। গত বছরের শুরুতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যখন রণমূর্তি ধারণ করেছিল, তখন রবার্ট ফিস্ক তার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানালেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ইসরাইল ভারতের পক্ষ নিয়ে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তান সীমান্তের বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলায় ইসরাইলী বৈমানিকরাও অংশ নিয়েছিল বলে সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসমর্থিত খবর রটেছিল। তবে রবার্ট ফিস্ক আবিস্কার তুলে ধরলেন, বালাকোট হামলার পর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দফতর থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল তার ভাষা, পরিভাষা, শব্দের গাঁথুনি এবং প্রকৃতি হুবুহু তেল আবিব থেকে প্রকাশিত আইডিএফ’র বিবৃতির মত। নেতানিয়াহু প্রশাসনের সাথে ভারতের মুসলিম বিদ্বেষী বিজেপি’র এই আঁতাতকে একটি মারাত্মক এন্টি ইসলামিক কোয়ালিশন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন রবার্ট ফিস্ক। এমন অসংখ্য সত্য অনুসন্ধানী রির্পোট ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী কষ্টি পাথরে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন ফিস্ক। এ কারণে জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা গণমাধ্যম, এন্টি ইসলামিস্ট এজেন্ডার ধারক-বাহকরা রবার্ট ফিস্কের চলে যাওয়ায় স্বস্তিবোধ করলেও আমাদের জন্য, বিশ্বশান্তির জন্য রবার্ট ফিস্কের এই চলে যাওয়া অনেক বড় ক্ষতি। ফিস্কের মৃত্যুর পর ইন্ডিপেন্ডেন্টে সহকর্মী আইরিশ সাংবাদিক, প্যাট্টিক ককবার্ন বলেছেন, রবার্ট ফিস্ক শুধু একজন প্রতিভাবান সাংবাদিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম ইতিহাসবিদ, যিনি সত্যের আলোয় পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন। পরলোকে শান্তিতে থাকুন রবার্ট ফিস্ক।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Shafiqul Islam ২৫ নভেম্বর, ২০২০, ১০:৩৭ এএম says : 0
রবার্ট ফিস্ক এর বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতার বিষয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ জামালউদ্দিন বারী সাহেব-কে। রবার্ট ফিস্ক ! যার লেখনিতে সাম্রাজ্যবাদীদের চেহারা উম্মোচিত হতো। আমার খুব পছন্দের এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। ব্যস্ততার মাঝেও পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া তাঁর কলামগুলো পড়তাম। তাঁর মৃত্যু পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় / মানবতাবাদী মানুষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। পরজগতে শান্তিতে থাকুন মানবতাবাদী এই কলম যোদ্ধা।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন